“অনার্সের রেজাল্ট দিয়ে দিলো আপনাদের। সময়টা এখন নষ্ট কইরেন না। ভালমতো পড়াশোনা কইরেন। আর আপনাদের ক্লাসের সবাইকে বলবেন ক্লাবের (QMH) সেশনগুলা করতে। নয়ন স্যার খুবই এক্সাইটেড আপনাদের নিয়ে। আর আমাদের কিন্তু এইবার ফেস্ট করাই লাগবে। ঢাকা আসলে একদিন সময় করে প্লান-প্রোগ্রাম করে ফেলা লাগবে।” কথাগুলো মৃত্যুর ৭-৮ ঘণ্টা আগে মোবাইলে বলছিলেন অধ্যাপক ড. তসলিম সাজ্জাদ মল্লিক। তিনি পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। কিন্তু আমার কাছে তিনি ছিলেন একজন স্বপ্নবাজ, উদ্যমী পথপ্রদর্শক। স্যারের সাথে আমার কথাবার্তার শুরুর গল্পটা বেশিদিনের নয়।
বরাবরের মতোই বিরক্ত লাগা পরিসংখ্যান নিয়ে হতাশার শেষ ছিল না। এফএইচ হলের পুকুর পাড়ে আড্ডা দেয়ার ফাঁকে একদিন একজন বড় ভাই বললেন, “থার্ড ইয়ারে তসলিম স্যারের হাইপোথিসিস কোর্সটা মনোযোগ দিয়ে করিস। তারপরে দেখ পরিসংখ্যান কেমন লাগে।”
সেই থেকে স্যারকে জানা। ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন কাজে জড়িত থাকলেও স্যারের সাথে ফোর্থ ইয়ারের আগে ২/১ দিন ছাড়া কোনদিন কথা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। ফোর্থ ইয়ারের ক্লাস শুরু হবার প্রথম দিকে কাজী মোতাহার হোসেন পরিসংখ্যান ক্লাব গঠনের শুরু থেকেই স্যারের সাথে কথাবার্তা শুরু। তসলিম স্যার জানতেন আমার পরিসংখ্যান পছন্দ নয়। আজ হিসাব মিলাতে গিয়ে দেখি গত দুই বছরে হয়তোবা ডিপার্টমেন্টে তসলিম স্যারের সাথেই আমার সবচেয়ে বেশি কথোপকথন হয়েছে। এবং আশ্চর্য হলেও সত্যি, সেখানে পড়াশোনা সংক্রান্ত কোন কথাই হয়নি। কিন্তু পরিসংখ্যানের কল্যাণে ক্লাস, পরীক্ষা আর প্রথাগত বিদ্যার বাইরে গিয়ে পরিসংখ্যানকে জনপ্রিয় করতে স্যার নিরলস কাজ করে গেছেন মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। চিন্তা করে গেছেন পরিসংখ্যান, কাজী মোতাহার হোসেন পরিসংখ্যান ক্লাব এবং বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিয়ে। লক্ষণীয় বিষয়, উনার প্রথম সারির থেকে শেষ সারির ছাত্রদের নিয়ে চিন্তা ছিল বেশি এবং তাদের নিয়েই কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
তাঁর চিন্তাধারায় সব সময় ছিল পরিসংখ্যান। শেষ দিকে তিনি দিনরাত এক করে দিয়েছেন কাজী মোতাহার হোসেন পরিসংখ্যান ক্লাবকে নিয়ে। চিন্তা করতেন কীভাবে ক্লাবটিকে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যবহার করা যায়। পরিসংখ্যান এর ওপর অত্যন্ত গভীর জ্ঞান থাকলেও ক্লাসে স্যারের উপস্থাপনা ও পাঠদানের প্রক্রিয়া ছিল খুবই সাবলীল। প্রখর বুদ্ধিমত্তা নিয়ে চলা স্যারের স্বভাবসুলভ প্রথম উক্তি ছিল “আমি পরিসংখ্যানের খুব একটা জানি না। তবে চেষ্টা করছি কিছু শেখার। আপনারা মাঝেমধ্যে ভুলগুলো ধরে দিয়েন।”
যার নেতৃত্বে এই ক্লাব, যার অভাবনীয় ত্যাগের, শ্রমের ফসল এই ক্লাব, সেই ব্যক্তিটির সাথে বিভিন্ন কাজ করতে গিয়ে অবাক হয়ে শুধু দেখেছি। শুধু শিখেছি কত কঠিন একটি বিষয়কে অত্যন্ত সহজভাবে গ্রহণ করা যায়। কত সাবলীলভাবে কাজটি করা যায়, সেটি স্যারের কাছে ছাড়া অন্য কোথাও দেখিনি। খুবই অবাক লাগত তখন, যখন দেখতাম এরকম একজন ব্যক্তিত্ব আমাকে ফোন দিয়ে বা সরাসরি জিজ্ঞেস করত, “শাফিন আমারে কিছু বুদ্ধি দেন তো। কেমনে কী করুম।” বা “ক্লাবের পরবর্তী এই কাজগুলো করতে চাইতেছি। আপনি কী কন? আপনারা না কইলে তো এই কাজ করা যাইবো না।” সেটি শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, সবার ক্ষেত্রেই। ক্লাবের কাজে জড়িত থাকায় দেখেছি একজন লোক কতটা অমায়িক হতে পারে। একজন ছাত্রের সাথেও যখন কথা বলতেন, মনে হতো সম্পর্কটা ছাত্র-শিক্ষকের নয়, বন্ধুত্বের। সব কথা শুনতেন এবং ছাত্রদের কল্যাণে সর্বোচ্চটুকু করতেন।
কিছুদিন আগেই আমার এক বন্ধু স্যারকে বলেছিল সে পরিসংখ্যান নিয়ে কিছু করতে চায়। কিছু শিখতে চায়। কথা শোনা মাত্রই স্যার তার জন্য কী কী করা যায় সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রের প্রতি কতটা যত্নবান হতে পারে, তা তাঁকে না দেখলে বোঝা খুবই কষ্টকর।
অনার্স ফাইনাল এর শেষ দিন ডিপার্টমেন্টে এসে জানতে পারলাম স্যার অসুস্থ। হার্ট অ্যাটাক করেছন। হাসপাতালে ভর্তি। এর ৩/৪ দিন আগে কথা হয়েছিল যে, সেদিন স্যারের সাথে দেখা করব। ক্লাবের কিছু কাজ নিয়ে। অসুস্থতা জানার পর দেখতে যেতে চাইলাম কিন্তু অন্য একজন স্যার জানালেন ডাক্তার কথা বলা বা দেখা সাক্ষাৎ করতে নিষেধ করেছেন। তাই যাওয়া হলো না।
এর সপ্তাহ খানেক পর স্যার নিজেই কল দিয়ে বললেন বাসায় এসেছেন। এখন কিছুটা সুস্থ। অবাক হয়ে শুনতে লাগলাম, “হাসপাতালে কারো সাথে এইভাবে দেখা করতে দেয় না। বেশিরভাগ সময় একাই রেস্টে ছিলাম। ক্লাবের নেক্সট কিছু কার্যক্রম নিয়ে চিন্তা করছি। একা একা কী করুম! নয়ন স্যারের সাথে মেসেজে কথা হয়েছে । আমি সব ফাইনাল করে আপনাদের জানাব। আমি মনে হয় বেশি দৌড়াদৌড়ি করতে পারবো না। আপনাদেরই অ্যারেঞ্জ করা লাগবে।”
খুবই হতবাক হলাম। যার অবস্থা ছিল জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, সেই সময়ও তিনি পরিসংখ্যান নিয়ে চিন্তা করেছেন। ২৬শে জানুয়ারি রাতে মৃত্যুর সাত-আট ঘণ্টা আগেও স্যারের সাথে কথা হয়েছিল। এক অন্যরকম সুর। কথার চুম্বকাংশ- “শরীর-স্বাস্থ্য বেশি ভালো না। কয়েকদিন ধরে একটু বেশি খারাপ লাগছে। আপনার সাথে ক্লাবের নেক্সট প্লান শেয়ার করা দরকার। বলা যায় না কখন কী হয়! আমি না থাকলে আপনারা ক্লাবের সাথে থাকবেন। আপনাদের অনার্স শেষ হলেও যে যেখানেই থাকেন ক্লাবটার দিকে নজর রাইখেন।”
স্যারের শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করে বলেছিলাম, “আপনি এত টেনশন নিবেন না। যেদিন ডিপার্টমেন্টে আসবেন, সরাসরি বসে ফেস্টের পরিকল্পনা করব।” স্যার আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। বেশি কথা বললে অসুস্থতা বাড়তে পারে চিন্তা করে খুব বেশি কথা বলতে চাইনি। মনে হচ্ছিল, একদিনে অত কথা বলার দরকার কী! দেখা হলেই সব কথা হবে।
সেদিন স্যারও খুব তাড়াহুড়ো করছিলেন কথাগুলো বলার জন্য। আমিও তাড়াহুড়ো করেছিলাম লাইনটি কেটে দেয়ার জন্য। আজ আফসোস হচ্ছে। খুবই আফসোস হচ্ছে। আলাপটি আরও দীর্ঘায়িত হতে পারত!
- সায়েম শাফিনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a7%9f%e0%a7%87%e0%a6%ae-%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%ab%e0%a6%bf%e0%a6%a8/শনিবার, এপ্রিল ১৮, ২০২০
- সায়েম শাফিনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a7%9f%e0%a7%87%e0%a6%ae-%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%ab%e0%a6%bf%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, মে ১৪, ২০২০
- সায়েম শাফিনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a7%9f%e0%a7%87%e0%a6%ae-%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%ab%e0%a6%bf%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, জুলাই ৯, ২০২০
- সায়েম শাফিনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a7%9f%e0%a7%87%e0%a6%ae-%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%ab%e0%a6%bf%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২০
- সায়েম শাফিনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a7%9f%e0%a7%87%e0%a6%ae-%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%ab%e0%a6%bf%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৮, ২০২০