fbpx

আলোকবর্তিকা

কারো কাছে যেকোনো কিছু জানিয়ে সেটার আন্তরিক একটা মতামত যদি আশা করা যায় যেকোনো মুহূর্তে, তাহলে তাকে নিয়ে হঠাত করে কীভাবে স্মৃতিচারণ করা যায় – সেটা ভেবে ভেবে ক্লান্ত লাগছে এই গত কিছুদিন ধরেই। মনে হচ্ছে এইতো একটা ফোনকল অথবা ইমেইলের দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছি মানুষটার সামনে। এখনই হয়তো কথা বলা যাবে চাইলেই। হতাশ লাগলেই সঞ্জীবনী শক্তি পাওয়া যাবে তার কথা শুনে। বাংলার পাঁচ হয়ে যাওয়া মুখে হাসি চলে আসবে তার কথার হাস্যরসে। তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করি কী করে! হয়তো তার সাথে কিছু অভিজ্ঞতা লিখতে পারি, তার সম্পর্কে কিছু বলার চেষ্টা করতে পারি। তার বলা কিছু কথা জানাতে পারি। যেটা নিয়মিতই করে এসেছি আমার বহু বন্ধুবান্ধবের কাছে। কিন্তু সেসব বলতে গেলেই ক’দিন ধরে গলা ধরে আসছে। কারণ সেগুলো এখন স্মৃতি হয়ে গেছে। সেই মানুষটা  খুব অবেলায় বহু মানুষকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন মহাকালের যাত্রায়।

গত কয়েকবছরে কীভাবে কীভাবে যেন তসলিম স্যারের সাথে অনেক কথা, অনেক আড্ডার অভিজ্ঞতা হয়ে গেল। আর চলার পথে আলোকবর্তিকা হিসেবে যেন হাতে ধরে ক্রমশ আলোর দিকে এগিয়ে দেয়া একজন নির্ভরযোগ্য পথপ্রদর্শকে পরিণত হয়ে গেলেন তসলিম স্যার। যখনই একটু হতাশ লেগেছে, তখনই এই মানুষটা পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছেন, “আরেহ্‌, টেনশন কইরেন না। পারবেন এইটা! এমনে চিন্তা করেন…!” সেই কথাগুলোতে যে পরিমাণ মোটিভেশন থাকতো, তাতে আবার সাহস পেয়েছি নতুন করে সব শুরু করার। যদিও তার থিসিসের ছাত্র ছিলাম না। বরং ছিলাম ক্লাসের শেষ সারির পড়ালেখা না করা ছাত্র। তবুও কোন মোটিভেশনের জন্য তসলিম স্যারের দ্বার ছিল উন্মুক্ত। সেটা প্রতিটা ছাত্রের জন্যই তাই ছিল, কোন সংশয় ছাড়া।

প্যাপাইরাস অনলাইনে নিয়ে আসার কাজ আর QMH Statistics Club প্রতিষ্ঠার সময় অনেকটা একই সময়ে চলছিল। দুইটা গ্রুপের একই সময়ে কাজকর্ম চলতো। বলা ভালো, দৌড়াদৌড়ি চলতো। আবার অনেকে ছিল দুই গ্রুপেরই কমন সদস্য। দুই গ্রুপেই তাদের সমান দায়িত্ব। কাজ ভাগ করে নিচ্ছে, সব পড়ালেখাকে সাথে নিয়েও। ছাত্রছাত্রীরা আনন্দ নিয়ে হুটহাট সব করেও ফেলছে। আমিও তখন দৌড়ে যাচ্ছি সকলের সাথে। তসলিম স্যার যেহেতু ক্লাবের কো-অর্ডিনেটর, স্যারের সাথে বিভিন্ন সময়ে আলাপ হয় বিভিন্ন বিষয়ে। কত প্ল্যান তার মাথায় গিজগিজ করে। বলার সময় চোখ চকচক করে স্যারের। টানা বলে যান, এটা করলে ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হবে; আনন্দ নিয়ে পড়ালেখা করতে পারবে; আগে থেকে অনেক কিছু নিয়ে সচেতন থাকতে পারবে। পেছনের সারির ছাত্ররা এগিয়ে আসা শুরু করবে। আমার অনুযোগ থাকে, আগে কেন শুরু করলেন না স্যার। আমিও তাহলে কত এগিয়ে যেতাম! আফসোসের সাথে এসব বলে হেসে ফেলি। স্যার বলেন – সময় কি শেষ নাকি! বিভিন্নভাবে এটা ওটা চেষ্টা করতে বলেন। তারপর আমিও কত আইডিয়া শেয়ার করি, স্যার মনোযোগ দিয়ে শোনেন, গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করেন। চলতে চলতে দেখা গেল একটা কী দারুণ বন্ধুত্বের মতন সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেল! সাহস নিয়ে চিন্তা করি, অনার্সে পড়ালেখা করলাম না ঠিকমতো, মনোযোগ দিলাম না। এবার নাহয় উচ্চশিক্ষার দিকে যাবার চেষ্টা করি। পড়ালেখা শেখার চেষ্টা করি, সেখানেও তসলিম স্যার অকৃপণভাবে সাহায্য করলেন। অন্য বিভাগের বন্ধুদের কাছে গল্প করি আমার বিভাগের স্যারদের সম্পর্কে, অবাক হয়ে শুনে শেষে তারা একটাই মন্তব্য করে – “স্ট্যাটের এই টিচাররা এতো ভালো ক্যান!?” তসলিম স্যারের পরিচয় এক বাক্যে দিয়ে ফেলি – “আপাদমস্তক ভদ্র এবং বিনয়ী মানুষ”। মানুষ হলে তো এমন মানুষই হওয়া উচিত! আর আমার চোখেমুখে তৃপ্তি আসে কেবল ভালো কিছু মানুষের সাহচর্য পাওয়ার সৌভাগ্যের কথা বলেই!

কিছুদিন আগে আমি আমেরিকায় এসেছি পরিসংখ্যান নিয়ে পড়ালেখা করতে। জানিনা কতটুকু হবে, তবে তসলিম স্যারের বিরাট অবদান আমাকে পড়ালেখায় আবারো মোটিভেট করার পেছনে। ডেকে নিয়ে বলতেন, “জানি, লেখালেখি করতে পছন্দ করেন, কিন্তু…কিন্তু পড়ালেখাও তো একটু করে দেখতে হবে।“ উত্তরে বলি, “লেখালেখিও তো ভালো হয় না, স্যার!” তার জাদুর মত কথায় মোটিভেট হয়ে আমারও মনে হয় – তাইতো! পড়ালেখাটা একটু দেখা দরকার তো! পড়তে আসার আগে, দেখা করার সুযোগ পাইনি। কারণ, এবারে করোনার সময়ের মধ্যে যারা পড়তে এসেছে, তাদের অনেকটা যেন এক সপ্তাহের নোটিশে তল্পিতল্পা গুছিয়ে চলে আসতে হয়েছে। আসার আগের দিন ফোনে আফসোসের সাথে বললাম, কারো সাথে দেখা করে যাবার সুযোগ পাচ্ছিনা, খুব খারাপ লাগছে। উত্তরে বললেন, দেখা তো হবেই পরে, এখন লাগেজ গোছান ঠিকমতো। এইটা নিয়েন, সেইটা নিয়েন…কত কথাই বললেন। তবে এছাড়াও কথাতো নিয়মিতই হয়েছে ফোনে। আলোচনা করতাম কত বিষয়ে। নতুন কত প্ল্যান করলেন, সেসব বলতেন। এই  সেমিনার করবেন, সেই ওয়ার্কশপ করবেন। অনলাইনের সুবিধা পুরোপুরি নিতে হবে আপাতত। সবাইকে জানাতে বলতেন। আমাকেও যোগ দিতে বলতেন। তবে প্রত্যেক আলাপের শেষে সারমর্ম থাকতো, ছাত্রছাত্রীর উপকার হবে কী করলে! পিছিয়ে পড়ছে যারা, এগিয়ে আসবে কী করলে! কী জানি, আমিও পিছিয়ে পড়াদের দলে ছিলাম কিনা – আমার কাছে পিছিয়ে পড়াদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে প্রাইমারি ডেটা সংগ্রহ করতেন কিনা! জানিনা, শুধু জানি তিনি ছাত্রছাত্রীর জন্য সার্বক্ষণিক চিন্তা করেন।

শেষ বার কথা হলো ইমেইলে। ইমেইলের রিপ্লাই থেকে জানলাম, হার্টএটাক নিয়ে তিনি হাসপাতালে। হাসপাতাল থেকে সবসময়ের মতো রসিকতা করে বললেন, হার্টে রিং পরানো হয়েছে,  তাই বলে যেন ভেবে না বসি সেটা ওয়েডিং রিং! এরপরে আরও কিছু কথা হলো জানুয়ারির ২২ তারিখ পর্যন্তও। এরপর মাত্র কয়েকদিনের মাথায় বিভীষিকার মতো দুসংবাদ শুনলাম। বিভিন্ন সময়ে তার বলা কথাগুলো কানে যেন বাজে খুব স্পষ্টভাবে। কিন্তু এখন ভেবে দেখলে মনে হয়, সে কথাগুলো আসলে যেন একপ্রকার জীবনদর্শন পরিবর্তনকারী কথাবার্তা। সেই কথাগুলো বুকের গভীরকোণে আমি যত্ন করে রেখে দিবো যতদিন বেঁচে থাকি।

এই লেখা শেষ হবেনা যদি স্যারের সবসময়ের একমাত্র মেসেজ যেটা ছিল, সেটা বর্তমান শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে না বলে যাই। এই কথাগুলো সবসময় স্যার জুনিয়রদের বলতে বলতেন, যেন তারা ক্লাসটাকে মন থেকে উপভোগ করতে না পারলেও যেন এসে সামান্য একটু কষ্ট করে চুপচাপ বসে থাকে ক্লাসে। অন্তত কিছু শোনে এসে। দেখা যাবে না চাইতেই অনেককিছু শেখা হয়ে গেছে। সহজে পাশ হয়ে গেছে। পিছিয়ে পড়া আর হচ্ছে না কারো। পাশ করে নাহয় পরিসংখ্যানে থাকলো না, কিন্তু অন্য কিছুতে একটু আগে ঢুকে যাওয়া গেল। জীবনকে সঠিক দিকে প্রবাহিত করার সময়টা পাওয়া গেল আরেকটু আগে। তা নাহলে পরিসংখ্যান বিভাগের রি-এডমিশন এবং ঝরে পড়ার যে লিগেসি সেটা শেষ হবেনা। এই বিভাগের আসল লিগেসি হলো এখানে তসলিম স্যারের মত শিক্ষক। এবং সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লিগেসি হওয়া উচিত। রি-এডমিশন কিংবা ঝরে পড়া নয়। তবেই আমরা তসলিম স্যারের স্বপ্নগুলোর দিকে যেতে পারবো। হয়তো, তসলিম স্যার ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস করা দেখে স্মিত হাসি ঠোঁটে নিয়ে চারতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবেন। যেমনটা থাকতেন সবসময়।

সাকিব ইবনে সালাম

সেশন - ২০১১ - ২০১২