fbpx

গল্প যখন সত্যি!

ছোট্ট টেবিলটার ওপাশে বসা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে শাহেদের মনে কোন ভাবান্তর হল না। মেয়েটার যে দিকটা তাকে আকর্ষণ করতে পারত তা হচ্ছে মেয়েটার রূপ, মেয়েটি বেশ রূপবতী। তবে শাহেদের কাছে প্রায়ই বেশ রূপবতী মেয়েরা এসে থাকে, তাই প্রথম প্রথম এটা তাকে আকর্ষণ করলেও এখন আর তেমন করে না। শাহেদ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল; যে হাসির অর্থ হচ্ছে, ‘আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো, কাজ শেষ না করে কথা বলতে পারছি না’। এটা এক ধরনের সূক্ষ্ম অপমান, এই অপমানটা করে শাহেদ কেমন যেন একটা পৈশাচিক আনন্দ পায়। এটা যেন এক ধরনের বুঝিয়ে দেয়া যে তুমি আমার কাছে এসেছ, আমি তোমাকে যতক্ষণ ইচ্ছে বসিয়ে রাখতে পারি। এমনটা না যে সে খুব জরুরি কিছু করছে; সে একটা লুতুপুতুটাইপ প্রেমের কবিতা লেখার চেষ্টা করছে, এটা পরে করলেও এমন বড় কোন ক্ষতি হয়ে যাবে না। তবু সে এমন ভাব করছে যেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা করছে সে। এমনটা করলে নিজের দামটা যে বেশ বাড়িয়ে নেয়া যায় তা এতদিনে তার থেকে ভাল আর কেউ জানে বলে শাহেদের মনে হয় না।


সে একজন পেশাদার লেখিয়ে। টাকার বিনিময়ে সে গল্প, কবিতা, ছড়া এসব লিখে দেয়। ছোট থেকেই তার লেখালেখির হাত বেশ ভাল ছিল। স্কুল কলেজে থাকতে ম্যাগাজিনে সবসময়ই তার লেখা থাকত। আর ভার্সিটিতে ঢোকার পর থেকে পত্রিকায় টুকটাক লেখালেখি শুরু করে সে। এখন সে মোটামুটি জনপ্রিয় বলা চলে। পেশাদার লেখিয়ে হবার চিন্তাটা তার মাথায় মূলত স্কুল জীবনেই ঢুকেছিল। সে যে লেখালেখি করে সেটা তখন পরিচিত প্রায় সবাই জানত। এটার জন্য বন্ধুমহলে একটা আলাদা জায়গা ছিল তার, সবাই একটু অন্য নজরে দেখত তাকে। বন্ধুরা তার কাছে প্রায়ই আবদার করত তাদেরকে গল্প কবিতা লিখে দেয়ার জন্য, যাতে তারা সেগুলো নিজেদের নামে ম্যাগাজিনে জমা দিতে পারে। সে লিখে দিত, বদলে বন্ধুরা তাকে এটা-সেটা খাওয়াত। তখনই তার মাথায় এসেছিল যে সে যদি ভবিষ্যতে এটা করে তাহলে সে সহজেই অনেক আয় করতে পারবে। তো পত্রিকায় লেখালেখি করে কিছুটা জনপ্রিয় হওয়ার পর সে তার পুরনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে লেগে পড়ল। একটা ঘর ভাড়া নিয়ে সাইনবোর্ড লাগাল, ‘এখানে চাহিদানুযায়ী গল্প কবিতা লিখে দেওয়া হয়’। এমন ভিন্নধর্মী একটা ব্যাপার খুব সহজেই মানুষের নজর কাড়ল। অনেকে অবশ্য তার সমালোচনা করে বলল যে সে সাহিত্যকে পণ্য বানিয়েছে, কিন্তু তা যে ধোপে টেকেনি তার প্রমাণ হচ্ছে আজকে তার এই অবস্থান। আগের চেয়ে বহুগুণ জনপ্রিয় সে। তার কাছ থেকে গল্প কবিতা লেখানোর জন্য মানুষের লাইন লেগে থাকে, বিশেষত তরুণ তরুণীদের। সে এখনো মাঝেমাঝে চিন্তা করে যে এই অদ্ভুত বুদ্ধিটা তার মাথায় এসেছিল কী করে!


পাক্কা বিশ মিনিট পর মাথা তুলে তাকালো শাহেদ। মেয়েটা এখনো ঠিক সেভাবেই বসে আছে।

“সরি, আপনাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করালাম।”

“নো প্রবলেম, ইটস ওকে।”

“বলুন আপনার জন্য কী করতে পারি? আর আপনার নামটা?”

“আমি নিশু।”

“তা মিস নিশু, কী লেখাবেন- গল্প নাকি কবিতা?”

“না আমি গল্প কবিতা এসব কিছুই লেখাবো না। আমি আসলে অন্য একটা কাজে এসেছি।”

শাহেদ একটু নড়েচড়ে বসল। তার কাছে মানুষ সাধারণত গল্প কবিতা এসব লেখানো ছাড়া এমনিতে তেমন একটা আসে না। সে বেশ কৌতুহল বোধ করল।

“কী কাজ বলুন।”

“আমি আপনার কাছে একটা সমস্যা নিয়ে এসেছি। আমার ধারণা একমাত্র আপনিই এ সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।”

“বলুন কী আপনার সমস্যা? তবে আমি কিন্তু কোন ডাক্তার নই!”

“ব্যাপারটা মোটেও মজা করার মত না।”

“ওকে আই এম সরি! আপনি বলুন।”

“ব্যাপারটা হচ্ছে আপনি যে ধারাবাহিক গল্পটা পত্রিকায় লিখছেন সেটা আমার জীবনের সাথে মিলে যাচ্ছে।”

“মানে?”

“মানে আপনি যে যেটা লিখছেন সেটা আমার জীবনেও সত্যি হয়ে যায়। সেগুলো আমার জীবনেও ঘটে।”

“কী বলছেন এসব! এটা কিভাবে সম্ভব?”

“কিভাবে সম্ভব তা আমিও জানি না তবে এটাই ঘটছে।”

“অবিশ্বাস্য ব্যাপার!”

“এখন একমাত্র আপনিই পারেন আমাকে সাহায্য করতে। আমি এটা থেকে মুক্তি চাই।”

“আমি কিভাবে সাহায্য করব?”

“আমি কিচ্ছু জানি না, আমি শুধু এটা থেকে মুক্তি চাই। আপনার যত টাকা লাগে আমি দেব, আমাকে শুধু এটা থেকে উদ্ধার করুন।”

“আচ্ছা আমাকে কিছুদিন সময় দিন। আমি একটু চিন্তা ভাবনা করি।”


শাহেদের মাথায় জিনিসটা ভালমতোই চেপে বসেছে। নিশু মেয়েটাও পরদিনই একটা লোকের হাতে দশ হাজার টাকার একটা চেক পাঠিয়ে দিয়েছে তার কাছে। সে এখন অন্যসব কিছু বাদ দিয়ে সারাক্ষণ এটা নিয়েই ভাবছে। অবশ্য এমনিতেও সে এটা নিয়ে ভাবা ছাড়া অন্যকিছু করতে পারছেও না। অন্যকিছু লিখতে গেলেও মাথার মধ্যে এই ব্যাপারটাই ঘুরপাক খাচ্ছে তার। যেন এটার সমাধান বের করার আগ পর্যন্ত মুক্তি নেই তার। আর সমস্যাটাও একেবার অদ্ভুত ধরনের। মেয়েটা বলেছে সে যে গল্পটা পত্রিকায় লিখছে সেটা তার জীবনেও সত্যি হয়ে যায়। এখন তাকে এমন একটা কিছু লিখতে হবে যেটার মাধ্যমে এই জিনিসটা আর না ঘটে অর্থাৎ ব্যাপারটা বন্ধ হয়ে যায়। কী হতে পারে সেটা? বেশ কিছুদিন চিন্তার পর তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসল। হাসিমুখে খাতা কলম নিয়ে বসল সে, অবশেষে সমাধানটা পেয়েছে সে।


দরজা খুলে বেশ অবাক হল নিশু। একটা চিঠি এসেছে তার জন্য। ‘এখনকার দিনে আবার চিঠি পাঠায় কে!’- ভাবতে ভাবতে চিঠিটা নিল সে। চিঠি খুলতেই চোখে পড়ল গোটা গোটা হাতের লেখা,

“মিস নিশু,

ভাল আছেন আশা করি। আপনার সমস্যার সমাধান বের করেছি। তবে সেটা পাবার জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে আপনাকে। সামনের মাসের পত্রিকাটা দেখবেন। তারপর একবার এসে দেখা করে যাবেন।

শাহেদ।”


আজ এক তারিখ। নিশু পত্রিকাটা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। একটা অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরে আছে তাকে। এই অনুভূতিটার সাথে সে পরিচিত। প্রতি মাসে একবার করে এই অনুভূতিটার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে। এবারের অনুভূতিটা অবশ্য আরেকটু বিস্তৃত। অনিশ্চয়তার সাথে যোগ হয়েছে কৌতূহল আর উত্তেজনা। এবারের গল্পে আছে তার সমস্যার সমাধান। ধীরে ধীরে পত্রিকাটা খুলে গল্পটা বের করে সে। এক নিঃশ্বাসে গল্পটা শেষ করে নিশু। সে বুঝতে পারছে না এটা কী করে সমাধান হয়। তড়িঘড়ি করে শাহেদের সাথে দেখা করার জন্য বের হয় সে।

নিশুকে তড়িঘড়ি করে ঢুকতে দেখে শাহেদের তেমন কোন ভাবান্তর হল না। সে জানত গল্পটা পড়ামাত্র মেয়েটা ছুটতে ছুটতে আসবে। হাসিমুখে উঠে দাঁড়ায় সে।
“বসুন মিস নিশু।”
“আপনি এটা কেন লিখেছেন?”
“আমি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি কিনা বলুন?”
“হ্যাঁ।”
“এর থেকে কী প্রমাণ হয় জানেন?”
“কী প্রমাণ হয়?”
“এর থেকে প্রমাণ হয় পুরো ব্যাপারটা কাকতালীয়। আর এই ব্যাপারটা প্রমাণ করার জন্যই আমি গল্পে নিজেকে মেরে ফেলি।”
“কিন্তু গল্পে যেটা থাকে সেটাই যে সত্যি হয়।”
“হয় না মিস নিশু, গল্প কখনো সত্যি হয় না।”

নিশুর চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়। শাহেদের গল্পটার শেষ লাইনটা তার মাথায় ঘুরছে। “যদি লেখক না থাকে তাহলে গল্পও থাকবে না। আর গল্প না থাকলেই মুক্তি।” সে ধীরপায়ে শাহেদের দিকে এগিয়ে যায়। গল্প না থাকলেই তার মুক্তি। কারণ গল্প যে সত্যি হয়। তাকে গল্পটা সত্যি করতে হবে।

নিশুর সমস্যার সমাধানটা শাহেদ ঠিকই করল, কিন্তু সেই সমাধানে নিজের সমাধিস্থ হওয়াটা সে নিশ্চয় কল্পনা করেনি! 

সিভিল ইঞ্জিনিয়ার | আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়