fbpx

দ্য ডেডলি বুক

(শুরুর কথা)

অনার্স ফোর্থ ইয়ারের ভাইভা দিয়ে বের হলাম বিকেল চারটায়।

ভাইভা বোর্ডের ঘটনা আপনাদেরকে না জানিয়ে পারছি না, যদিও মূল ঘটনার সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই। বোর্ডের চারজন শিক্ষকের মধ্যে একজন ছিলেন আমাদের বিভাগের সবচেয়ে অজনপ্রিয় শিক্ষক রহমত আলি। তার নাম ‘রহমত আলি’ না হয়ে হওয়া উচিত ছিলো ‘গজব আলি’। যখন তখন ছাত্রদেরকে অপদস্থ করে তিনি এক ধরনের বিকৃত আনন্দ অনুভব করেন। আমি ভাইভা দেয়ার জন্য ভিতরে ঢুকতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘এই যে একজন আইনস্টাইন এসেছে, মিডিয়ান (median) কাকে বলে জানে না।’

রহমত স্যারের এই কমেন্টের একটা ভিত্তি আছে। ফোর্থ ইয়ারের শুরুর দিকে একদিন ক্লাসে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এই ছেলে, ৫, ৫, ৬, ৭ আর ৯ এই পাঁচটা নাম্বারের median কত?’ আমি median এর সাথে mode গুলিয়ে ফেলায় উত্তরে বলেছিলাম ‘৫’ (এখানে ৫ বেশি থাকায় mode হলো ৫, আর নম্বরগুলি ছোট থেকে বড় সাজানো থাকায় ঠিক মাঝখানের নম্বর ৬ হলো median)। ক্লাসের বাকি সময়টা রহমত স্যার ব্যয় করেছিলেন আমাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে – আমি ফোর্থ ইয়ারে পড়ি কিন্তু ফার্স্ট ইয়ারের পড়া পারি না, আমাকে ভার্সিটি থেকে বের করে দেয়া উচিত, ইত্যাদি।

আজ তিনি আবার আমাকে অপদস্থ করার চেষ্টা করছেন, তাও অন্য স্যারদের সামনে। এর ফলে হয়তো আমি ভাইভাতে কম নম্বর পাবো। মেজাজটা খিঁচড়ে গেল, কিন্তু মুখে কিছু বললাম না। জলে বাস করে কুমীরের সাথে ঝগড়া করতে চাই না।

আমি হ্যানসাম না হলেও আমার চেহারায় একটা ইনোসেন্ট ভাব আছে। প্রয়োজনে আমি সেটা বাড়িয়ে ফেলতে পারি। সেই গুনটা কাজে লাগিয়ে খুবই বিনীত গলায় বললাম, ‘জানি, স্যার।’

‘বলো দেখি, median কী?’ জানতে চাইলেন রহমত স্যার।

আমি সময় নিয়ে দুটো উদাহরণ ব্যবহার করে median এর সংজ্ঞা দিলাম। এক্সটার্নাল স্যার বললেন, ‘তুমি তো খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছো।’ রহমত স্যারকে দেখে মনে হলো তার মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়া হয়েছে। তিনি কী বলবেন খুঁজে পেলেন না। অন্য স্যারেরা আমাকে প্রশ্ন করে গেলেন। আমি প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম!

আমাকে যখন চলে আসতে বলা হলো, রহমত স্যার হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলো দেখি, median এর বাংলা কী?’

আমার মেজাজ পুরোপুরি বিগড়ে গেল। নম্বরের নিকুচি করি। আমি জানি পরিসংখ্যানে median এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘মধ্যক’। কিন্তু, ত্রিকোনমিতিতে median অর্থ ত্রিভুজের ‘মধ্যমা’। আবার ‘middle finger’ এর বাংলা প্রতিশব্দও ‘মধ্যমা’।

আমি চেহারায় ইনোসেন্ট ভাবটা বাড়িয়ে ডান হাতের মধ্যমা চিৎ করে রহমত স্যারের দিকে তাক করে বিনীত কণ্ঠে বললাম, ‘স্যার, median এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো মধ্যমা।’

স্যার হাসবেন না কাঁদবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। এক পর্যায়ে রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি কি জানো না এ রকম ভঙ্গির অর্থ কী?’

আমি অবাক হওয়ার ভান করলাম। সেই সাথে চেহারায় একটা বোকা ভাব এনে অসহায়ের মতো অন্য স্যারদের দিকে এমনভাবে তাকালাম, যেন আমি তাদের সাহায্য কামনা করছি। তাতে কাজ হলো। এক্সটার্নাল স্যার বললেন, ‘যাও। এ রকম ভঙ্গির মানেটা জেনে নিও।’

‘গজব আলি’ স্যারকে মধ্যমা দেখিয়েছি বলে বন্ধুমহলে আমার জনপ্রিয়তা বেড়ে গেল। চারজন বন্ধু আমাকে ধানমন্ডি স্টার কাবাবে নিয়ে গেল। পেট ভরে নানা রকমের কাবাব খেলাম। ওরা চারজন মিলে বিল দিলো, আমার এক টাকাও খরচ হলো না। আমি আমার বিল দিতে চাইলে একজন বন্ধু বললো, ‘মোটেও না, আরমান, তুই হলি আমাদের মধ্যমা।’

বন্ধুরা সিনেমা দেখতে বসুন্ধরা সিটিতে চলে গেল। ওদের সাথে গেলে বিনে পয়সায় সিনেমা দেখতে পারতাম, কিন্তু ইচ্ছে হলো না। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি গেলাম নীলক্ষেতে, উদ্দেশ্য একটা গল্পের বই কেনা।

পুরনো বইয়ের দোকানগুলোতে ঘন্টাখানেক খুঁজে একটা বই পছন্দ করলাম, এলিজাবেথ পিটার্স-এর লেখা ‘Die for Love’। একটা রিকশা নিয়ে শহীদুল্লাহ হলে ফিরলাম।

(১)

‘ডাই ফর লাভ’ বইটি একটি রহস্য উপন্যাস। প্রচ্ছদে একটা উড়ন্ত পাখির ছবি – পায়রা বা ঘুঘু – ভালবাসার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মৃত্যুর কোনও চিহ্ন প্রচ্ছদে নেই। কাভার পৃষ্ঠা ওল্টাতেই চোখে পড়ে, প্রথম পাতায় কলম দিয়ে লেখা হয়েছে:

Siraj Ahmed
13/01/1994

বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৪ সালে। এর প্রায় দশ বছর পরে (আমার জন্মের ছয় বছর আগে) সিরাজ নামের কেউ এটি নতুন অবস্থায় কিনেছে, হয়তো নিউ মার্কেটের কোনও দোকান থেকে। এর প্রায় ত্রিশ বছর পরে বইটি আমার হাতে এলো। মাঝে খুব একটা হাতবদল হয়েছে বলে মনে হয় না। বইটি এখনও ভালো অবস্থায় আছে।

পরের পাতায় লেখা রয়েছে:

Rehnuma
812961

ছয় অংকের নম্বরটি টেলিফোন নম্বর বলেই মনে হলো। ঐ সময়ে টেলিফোন নম্বর ছয় অংকের ছিলো। মোবাইল ফোনের ব্যবহার শুরু হয়নি।

রেহনুমার নাম আর ফোন নম্বর সিরাজ লেখেননি, হাতের লেখা আলাদা। ভদ্রমহিলা কি বইটির দ্বিতীয় মালিক? নাকি যোগাযোগের জন্য সিরাজকে নিজের ফোন নম্বর লিখে দিয়েছেন?

আমি খুব কৌতূহলী ছেলে। আর কোনও কিছু লেখা আছে কিনা দেখতে গল্প পড়া বাদ দিয়ে বইটির পাতা ওল্টাতে লাগলাম। দেখা গেল, তেরো নম্বর পৃষ্ঠার নিচের দিকে লেখা রয়েছে:

Juliet must die (2001)

এভাবে সাধারণত মুভির নাম লেখা হয়। আমি অনেক মুভি দেখি (যদিও আজ দেখতে যাইনি) এবং মুভির খোঁজখবর রাখি। ‘Romeo Must Die’ নামের একটি মুভি ২০০০ সালে তৈরি হয়েছে যা আমি বছর দুই আগে দেখেছি। পরের বছর কি মুভিটির একটি সিকোয়েল তৈরি হয়েছিলো? তাহলে তো আমার জানার কথা!

নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি Google-এর সার্চ বক্সে ‘Juliet must die’ টাইপ করলাম। দেখলাম এই নামে একটি জার্মান ছবি তৈরি হয়েছে ২০২০ সালে। অন্য কোনও সালে বা অন্য কোনও ভাষায় এই নামে মুভি তৈরি হয়নি।

২০২০ লিখতে গিয়ে ভুল করে ২০০২ লেখা হয়তো সম্ভব, কিন্তু ২০০১ লেখা প্রায় অসম্ভব। তাহলে?

চেক করে দেখলাম, বইয়ের অন্য কোনও পৃষ্ঠায় কোনও কিছু লেখা নেই।

হাতের লেখা দেখে মনে হচ্ছে Juliet must die (2001) কথাটি সিরাজের লেখা। তিনি কি ২০০০ সালে Romeo Must Die মুভিটি দেখেছেন, তারপর আশা করেছেন ২০০১ সালে এর একটা সিকোয়েল বের হোক? মনে হয় না। একটা কাল্পনিক মুভির নাম লিখলেও পাশে সাল লিখে ফেলাটা অস্বাভাবিক। তাছাড়া, মুভির নাম লেখার সময় প্রত্যেক শব্দের প্রথম অক্ষর সাধারণত capital letter লেখা হয়। এক্ষেত্রে তেমনটা করা হয়নি।

লেখার জন্য নীল কালির বলপয়েন্ট পেন ব্যবহার করা হয়েছে। একটা ব্যাপার লক্ষ করে আমি অবাক হলাম – ‘Juliet must die’ লিখতে চিকন দাগের কলম আর ‘(2001)’ লিখতে মোটা দাগের কলম ব্যবহৃত হয়েছে। আরও লক্ষ করলাম, ‘Juliet must die’ কথাটি লেখার পর ফুলস্টপ দেয়া হয়েছিলো, এরপর সেই ফুলস্টপের উপর দিয়ে ব্রাকেট লেখা হয়েছে। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, ‘(2001)’ অংশটি পরে যোগ করা হয়েছে। তার মানে, এখানে কোনও মুভির নাম লেখা হয়নি। কেউ একজন (সিরাজ?) লিখেছে, জুলিয়েটকে মরতে হবে। তারপর, হয়তো জুলিয়েটের মৃত্যুর পর, নিজের সংশ্লিষ্টতা গোপন করার জন্য লেখাটির পাশে একটি সাল বসিয়ে মুভির নাম হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছে।

এটা কি আমার অতি-কল্পনা? চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম আমি।

(২)

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই বইটির কথা মনে পড়লো। শোয়া অবস্থাতেই হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে বইটি নিলাম। ‘Juliet must die’ লেখাটি মনোযোগ দিয়ে বার বার পড়তে লাগলাম। এক পর্যায়ে আমার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হলো ‘Juliet’ শব্দটি।

হঠাৎ খেয়াল করলাম, ‘Juliet’ শব্দটির ‘t’ অক্ষরটি লিখতে মোটা দাগের কলম ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে বাকি অক্ষরগুলি চিকন দাগের কলমে লেখা। আরও লক্ষ করলাম, ‘e’ আর ‘t’ অক্ষর দুটির মাঝখানে কিছুটা ফাঁক আছে। কেউ যদি ‘et’ একসাথে লেখে, তাহলে ‘e’ এর শেষ বিন্দুতে কলম না ছেড়ে একটানে ‘t’ লিখে ফেলে। এখানে তেমনটা করা হয়নি। কোনও সন্দেহ নেই, ‘t’ অক্ষরটি পরে লেখা হয়েছে। মূল লেখাটি হলো:

Julie must die.

জুলিকে মরতে হবে! কে ছিলো এই জুলি? তার সাথে সিরাজের সম্পর্ক কী ছিলো? সত্যিই কি জুলিকে মরতে হয়েছে? তা না হলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে কেন?

প্রায় দুই যুগ আগের ঘটনা, তবুও জুলির ভাগ্যে কী ঘটেছিলো, তা জানতে ভীষণ ইচ্ছে হলো। সিরাজ বা জুলির কোনও ঠিকানা/ফোন নম্বর লেখা নেই। একমাত্র সূত্র রেহনুমার পুরনো (ছয় অংকের) টেলিফোন নম্বরটি।

শহীদুল্লাহ হলের এক বড় ভাই টিএন্ডটি-তে চাকুরি করেন। তাকে কল করে জানতে পারলাম, ৮১২৯৬১ নম্বরটি ১৯৯৮ সালে সাত অংকের ৯১১২৯৬১ নম্বরে মাইগ্রেট করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, নম্বরটি এখন আর চালু নেই। অনেক অনুরোধের পর পুরনো ফাইল ঘেঁটে তিনি আমাকে জানালেন, নম্বরটি কোনও এক বশির উদ্দিনের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিলো, যার বাসার ঠিকানা ৯/৬ ইকবাল রোড, মোহাম্মদপুর।

দুপুর বারোটায় আমি ইকবাল রোডের ঠিকানায় পৌঁছালাম। বশির উদ্দিনের বাড়িটি লালচে সিরামিক ইটের ডুপ্লেক্স। রাস্তার উল্টোপাশে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম, কোন্ অ্যাপ্রোচে কথা বললে বশির সাহেব (যদি এখনও বেঁচে থাকেন) বা রেহনুমা বিরক্ত হবেন না।

রাস্তা পার হয়ে গেটের কাছে যেতেই দারোয়ানের সাথে চোখাচোখি হলো। তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাবে জানতে চাইলাম, ‘রেহনুমা আন্টি কি আছেন?’ ১৯৯৪ সালে রেহনুমার বয়স যদি বিশ বছরও হয়ে থাকে, তাহলে এখন তার বয়স পঞ্চাশ বছর – তাই আন্টি বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

দারোয়ান ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘এই নামের কেউ তো এইখানে থাকে না।’

‘বশির সাহেব থাকেন?’

‘আপনে বোধ হয় আগের মালিকের কথা বলতেছেন। আমার স্যারে বছর দশেক আগে এই বাড়িটা কিনা নিছে।’

‘আগের মালিকেরা কোথায় থাকেন?’

‘আগের মালিক তো মারা গেছে। তার ছেলে-মেয়ের কাছ থেইকা বাড়ি কিনছে আমার মালিক। ছেলে-মেয়ে কোথায় থাকে বলতে পারি না।’

‘আপনার মালিক বলতে পারবেন?’

‘জানি না। মালিক তো বাসায় নাই।’

হতাশ হলাম। ধীর পায়ে হেঁটে মোড়ের দোকানের কাছে গেলাম। নাম ‘ভ্যারাইটি স্টোর’। মালিক (অথবা কর্মচারী)-এর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, মাঝারি গড়ন।

‘রেহনুমা আন্টিকে চিনেন? লাল ডুপ্লেক্সটাতে থাকতেন?’ জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

‘হ্যাঁ, চিনি।’

দোকানি প্রেজেন্ট টেন্স-এ কথা বলছে দেখে উৎসাহিত হলাম। জানতে চাইলাম, ‘তিনি এখন কোথায় থাকেন?’

‘আপনি তার কী হন? না জেনে অ্যাড্রেস দিতে চাই না।’

‘আমি ঢাকা ভার্সিটির স্টুডেন্ট,’ বললাম আমি। আই.ডি. দেখালাম। ‘একটা দরকারে তার সাথে কথা বলতে চাই।’

পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটু দূরে সরে গিয়ে দোকানি কল করলেন। কিছুক্ষণ কথা বলে আমার দিকে মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘রেহনুমা আপার সাথে কথা বলেন।’

‘আসসালামু আলাইকুম। আমাকে আপনি চিনবেন না, আমি –’

‘শুনলাম তুমি ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র,’ রেহনুমা বললেন। ‘কোন ডিপার্টমেন্টে?’

‘পরিসংখ্যান। অনার্স ফোর্থ ইয়ারের পরীক্ষা শেষ করলাম।’

‘আমিও ঢাকা ভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলাম – সেই কবেকার কথা। তোমাকে তুমি করে বললাম। বলো কী জানতে চাও?’

‘সামনা-সামনি কথা বলা যাবে?’

‘কেন? ফোনে বললে কী সমস্যা?’

‘সেটাও সামনা-সামনি বলতে চাই।’

একটু দ্বিধা করলেন রেহনুমা। তারপর বললেন, ‘আচ্ছা আসো।’ ধানমন্ডি ৭/এ এর একটা অ্যাড্রেস দিলেন তিনি।

দোকানিকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি দ্রুত ধানমন্ডির পথ ধরলাম।

(৩)

রেহনুমা আন্টিদের ধানমন্ডির বাসাটিও ডুপ্লেক্স, তবে হলদে সিরামিক ইটের তৈরি। কেয়ারটেকার আমাকে নিচতলার ড্রইংরুমে বসিয়ে চলে গেলেন। পুরো রুমটিতে রুচি আর আভিজাত্যের ছাপ।

রেহনুমা আসতেই আমি উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। আমার ধারণা তার বয়স পঞ্চান্নের কম হবে না, কিন্তু চেহারায় এখনও অম্লান সৌন্দর্য।

আমাকে বসতে বলে নিজেও বসলেন রেহনুমা। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার বলো তো?’

আমি জ্যাকেটের পকেট থেকে বইটি বের করলাম। পাতা উল্টিয়ে ছয় অংকের ফোন নম্বরটি বের করে তাকে দেখালাম। বললাম, ‘এটা নিশ্চয়ই আপনার লেখা?’

হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে বইটি দেখলেন রেহনুমা। তার চোখেমুখে একসাথে বিস্ময়, বেদনা আর স্মৃতিকাতরতা ফুটে উঠেছে।

‘হ্যাঁ, এটা আমার লেখা,’ নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন রেহনুমা। ‘কিন্তু, তুমি এই বই কোথায় পেলে?’

‘নীলক্ষেত থেকে কিনেছি। পুরনো বইয়ের দোকানে।’

‘এখনও বুঝতে পারছি না তুমি আমার কাছে কেন এসেছো?’

‘বইটির প্রথম মালিক সিরাজ আহমেদ – আপনি তো তাকে চিনেন, তাই না?’

‘চিনতাম। কিন্তু, এখন যোগাযোগ নেই। কেন বলো তো?’

‘আপনি কি জুলি নামের কোনও মেয়েকে চিনতেন?’ উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম।

‘না। কিন্তু, তুমি এসব কেন জিজ্ঞাসা করছো, তা তো বলছো না।’

রেহনুমাকে আমি পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলাম। বইয়ে লেখা কথাটি তাকে দেখালাম। সবশেষে বললাম, জুলিকে সত্যিই মরতে হয়েছিলো কিনা তা আমি জানতে চাই।

‘আমি তো কোনও তথ্য দিতে পারবো না। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে সিরাজের সাথে আমার যোগাযোগ নেই।’

‘আপনার সঙ্গে তার পরিচয়টা, মানে –’

‘ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে তোমার সাথে –’ বলতে গিয়ে থেমে গেলেন রেহনুমা। একটু দ্বিধা করলেও মনস্থির করে বললেন, ‘তবে, আমি বুঝতে পারছি তুমি সম্ভাব্য মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করছো, যদিও আনঅফিসিয়ালি। তোমাকে খুলে বলাই ভালো, যাতে আমার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তোমার মনে কোনও ভুল ধারণা তৈরি না হয়।’

একটু থেমে রেহনুমা বললেন, ‘সিরাজ আর আমি মোহাম্মদপুরের গ্রীনহেরাল্ড স্কুল থেকে একসাথে ‘এ’ লেভেল পাশ করেছি। দুজনই ঢাকা ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছি – আমি ইংলিশে আর সে ইকনোমিক্সে। আমি তাকে পছন্দ করতাম, কিন্তু দুই ফ্যামিলির আপত্তি থাকায় আমাদের সম্পর্কটা এগোয়নি। আমার ফ্যামিলি মনে করতো সিরাজের ফ্যামিলি আমাদের সমকক্ষ নয়। আর সিরাজের ফ্যামিলির আপত্তি ছিলো আমার বয়সে।’

আবার একটু থেমে রেহনুমা বললেন, ‘১৯৯৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমার মাস্টার্সের রেজাল্ট হলো। ঐ বছরই ডিসেম্বরে আমার বিয়ে হলো। আমার স্বামী আর্কিটেক্ট, বাই দ্য ওয়ে, এবং খুব ভালো মানুষ। সঙ্গত কারণেই সিরাজের সাথে আর যোগাযোগ রাখিনি।’

‘সিরাজ আংকেল নিশ্চয়ই আপনার ফোন নম্বর জানতেন। তাহলে হঠাৎ করে আপনি কেন বইয়ে ফোন নম্বরটা লিখতে গেলেন?’

মুচকি হাসলেন রেহনুমা। বললেন, ‘আমি যে সিরাজকে পছন্দ করি, তা ওকে বোঝাতে চেয়েছি। তবে, পরদিন ও আমাকে জানিয়েছে, ওর ফ্যামিলি চায় না ও সমবয়সী কাউকে বিয়ে করুক। আমি আর কথা বাড়াইনি।’

‘সিরাজ আংকেলের ঠিকানাটা একটু দিবেন?’

‘আজিমপুরে ওর বাবার চারতলা বাড়ি ছিলো। ওরা এখনও ওখানে থাকে কিনা জানি না। আজিমপুরের নিউ পল্টনে ‘ইরানী হোটেল’ নামে একটা নামকরা রেস্টুরেন্ট আছে, এলাকার সবাই চিনে। তার উল্টোপাশে সিরাজদের সাদা রঙের বাড়ি।’

নুডলস, কেক আর কফি দিয়ে আমাকে আপ্যায়ন করা হলো (দুপুরের খাওয়ার খরচটা বাঁচলো)। রেহনুমা আন্টিকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটা রিকশা নিয়ে আজিমপুরের পথ ধরলাম।

(৪)

‘ইরানী হোটেল’ খুঁজে পেতে কষ্ট হলো না। রাস্তার উল্টোপাশে চারতলা সাদা বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, নাম ‘Meena’s Dream’। মিনা কে? সিরাজ সাহেবের মা, নাকি স্ত্রী?

সাড়ে তিনটা বাজে। এখন বাড়ির লোকদেরকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। ইরানী হোটেলে ঢুকে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম।

চারটার দিকে উঠে চায়ের বিল দিয়ে রাস্তা পার হলাম। Meena’s Dream এর গেটে দারোয়ানকে পেলাম না। বাইরে থেকে বিল্ডিংটা দেখলে ধারণা করা যায়, মালিক দোতলায় থাকেন। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে আমি জ্যাকেটের পকেট থেকে বইটা বের করলাম। এটি হাতে থাকলে সিরাজ সাহেবের সাথে কথা বলতে সুবিধা হবে।

কলিংবেল বাজানোর পর এক মিনিট পার হয়ে গেল, কেউ দরজা খুললো না। আবার কলিংবেল বাজাতেই একজন ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন। সম্ভ্রান্ত চেহারা।

‘কাকে চান?’ প্রশ্ন করলেন তিনি। পরক্ষণেই তার চোখ গেল আমার হাতের বইটির দিকে। একটু ধাঁধাঁয় পড়লেন মনে হলো। হয়তো ভাবছেন, বইটি এই ছেলের হাতে গেল কীভাবে?

‘এটা কি সিরাজ আংকেলের বাসা?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি –’

বুঝতে পারলাম ইনি মিসেস সিরাজ। বললাম, ‘আমার নাম আরমান। ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ি, পরিসংখ্যানে। সিরাজ আংকেলের সাথে একটু কথা বলতে চাই।’

‘কী ব্যাপারে কথা বলবেন?’

‘তাকেই বলতে চাই,’ বললাম আমি। পরক্ষণেই যোগ করলাম, ‘এই বইটি নিয়ে আলাপ করবো।’

মিসেস সিরাজ আবার ধাঁধাঁয় পড়লেন। বললেন, ‘উনি তো বাসায় নেই। তবে একটু পরে চলে আসবে। আচ্ছা, আমি কল করে দেখি কখন আসবে। একটু দাঁড়ান।’

ভদ্রমহিলা ভিতরে চলে গেলেন। ফোনে কথা বলছেন বোঝা গেল। একটু পরে এসে বললেন, ‘স্যরি, তার অনেক দেরি হবে। আপনি সন্ধ্যার পর আসুন।’

‘ও.কে.’ বলে আমি নেমে এলাম। বইটা আবার জ্যাকেটের পকেটে স্থান পেলো।

উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটছি। সন্ধ্যা হতে এখনও প্রায় এক ঘন্টা বাকি।

‘এই যে, শুনুন।’ পিছন থেকে কেউ একজন ডাকলো। তাকিয়ে দেখি দুজন লোক দ্রুত পায়ে আমার দিকে আসছে। দুজনেরই বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। বেশভূষায় ভদ্রলোক মনে হলেও একজনের হাতে লাঠি। এরা কি ছিনতাইকারী? একদম কাছে চলে এসেছে, দৌড় দেয়ার চেষ্টা করে লাভ নেই।

‘কী ব্যাপার?’ বললাম আমি।

‘আপনার কাছে যে বইটা আছে, সেটা দিয়ে দিন।’ লম্বা লোকটি কথা বলছে। খাটো লোকটি (যার হাতে লাঠি) আমার পিছনে চলে গেছে।

‘আমার কাছে তো কোনও বই নেই,’ বলতে গিয়ে বললাম না। লাভ হবে না, বইটার কথা এরা জানে। বললাম, ‘কেন? এক শ’ টাকা দামের একটা বই দিয়ে কী করবেন?’

‘সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। ভালোয় ভালোয় বইটা দিয়ে দিন।’

‘দেবো না,’ বললাম আমি। জেদ চেপে গেছে।

লাঠির প্রথম বাড়িটি পড়লো আমার ডান কাঁধে। দ্রুত ঘুরে লাঠিওয়ালার মুখোমুখি হতে চাইলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে হোঁচট খেলাম। লাঠির দ্বিতীয় বাড়িটি পড়লো আমার মাথার বাম পাশে। মাটিতে পড়ে গেলাম।

জ্ঞান হারানোর পূর্ব মুহূর্তে বুঝতে পারলাম, আমার জ্যাকেটের পকেট থেকে বইটি বের করে নেয়া হচ্ছে।

(৫)

আমার জ্ঞান ফিরলো কোনও এক হাসপাতাল/ক্লিনিক-এর কেবিনে। দেয়াল ঘড়িতে দেখি তিনটা বাজে। বাইরে রোদ, তার মানে বিকেল তিনটা। নিশ্চয়ই পরের দিন।

আমাকে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। মাথায় ব্যান্ডেজ করা।

ভালো করে তাকিয়ে বুঝলাম এটা ভিআইপি কেবিন। প্রথমে ভয় পেলাম, আমার কাছে বিল চাইবে। পরক্ষণেই মনে হলো, আমাকে জিজ্ঞেস করে ভিআইপি কেবিনে আনা হয়নি। তাছাড়া, আমার মানিব্যাগে সাত শ’ টাকার বেশি নেই, বিল নিবে কীভাবে?

ভালো কথা, আমার মানিব্যাগ কোথায়? মোবাইলও তো নেই!

অপরিচিত এক ভদ্রলোক রুমে ঢুকলেন। আমার দিকে না তাকিয়ে অ্যাটেনডেন্ট এর বেডে বসে হাতের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আমি বুঝতে পারলাম, তিনি আমার দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত।

‘হ্যালো,’ বললাম আমি।

চমকে উঠে আমার দিকে তাকালেন ভদ্রলোক। পরক্ষণেই উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘ওহ, আপনার জ্ঞান ফিরেছে। দাঁড়ান, আমি আগে স্যারকে জানাই।’

স্যারের সাথে কথা শেষ করে আমার কাছে এসে ভদ্রলোক বললেন, ‘আমার নাম অপু। স্যার দশ মিনিটের মধ্যে চলে আসবেন।’

‘আমার মোবাইল আর মানিব্যাগ কোথায়?’

‘আপনার মোবাইল তো ভেঙে গেছে। স্যার আপনাকে নতুন একটা সেট কিনে দিবেন বলেছেন। আর, এই যে আপনার মানিব্যাগ।’

দেখলাম মানিব্যাগের ভিতরে সবকিছু ঠিক আছে। বললাম, আমার ভাঙা মোবাইলটা কোথায়? একটা কল করতে হবে।’

‘আপনার মোবাইলটা স্যারের কাছে। কল করার মতো অবস্থায় ওটা নেই।’

‘আপনার স্যারের নাম কি সিরাজ আহমেদ?’

‘হ্যাঁ।’

এত খাতির-যত্নের কারণ বুঝতে পারলাম।

কিছুক্ষণ পরে সিরাজ এলেন, হাতে আমার বইটি। অপুকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে একটা চেয়ার টেনে তিনি আমার বেডের পাশে বসলেন।

‘আমি সিরাজ আহমেদ, যার সাথে দেখা করতে এসে তুমি বিপদে পড়লে। তোমার ব্রেনের সি.টি. স্ক্যান করা হয়েছে। রিপোর্ট ভালো। তবে, তোমার মাথার বাম পাশে তিনটা সেলাই লেগেছে। আরও দু’তিন দিন ডাক্তারের কেয়ারে থাকতে হবে।’

একটু থেমে সিরাজ বললেন, ‘মনির, আমার শ্যালক, তোমার মাথায় আঘাত করতে চায়নি। তুমি হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলে বলে আঘাতটা মাথায় লেগেছে। ঐ সময়ে আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছি। যা হবার হয়েছে, তোমার চিকিৎসার সব খরচ আমি বহন করবো। একটা ভালো অ্যামাউন্টের টাকা ক্ষতিপূরণও দিতে রাজি আছি, যদি তুমি কোনও পাল্টা পদক্ষেপে না যাও।’

‘আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, আপনার ওয়াইফের হুকুমে আমার উপর অ্যাটাক হয়েছে?’

একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন সিরাজ। বললেন, ‘তুমি কী করে সেটা বুঝতে পারলে?’

‘বইটা একমাত্র তিনি দেখেছেন। তাছাড়া, তার সাথে আমার যে কথাবার্তা হয়েছে, তা আর কেউ শোনেনি।’

‘তুমি অনেক বুদ্ধিমান ছেলে। আচ্ছা, বইটা দেখে তুমি কী বুঝতে পেরেছো?’

আমি সিরাজ সাহেবকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলাম। শেষে জানতে চাইলাম, ‘Julie must die কথাটি নিশ্চয়ই আপনি লিখেছিলেন? জুলি কে?’

‘জুলির পরিচয় পরে বলছি। গতকাল রাতে সোনিয়ার সাথে, আই মিন, আমার স্ত্রীর সাথে ডিটেইলড আলাপ হলো। তোমার মতো সেও ভেবেছিলো কথাটি আমি লিখেছি। এই কারণেই কথাটি ঢাকার জন্য সে 2001 যোগ করেছে। একই কারণে সে তোমার কাছ থেকে বইটা নিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে।’

‘জুলি কে?’ আবার জানতে চাইলাম।

‘জুলি আমার প্রথম স্ত্রী পল্লবীর মেয়ে। ’৯৫ সালে পল্লবীর সাথে আমার বিয়ে হয়। ’৯৬ সালে জুলির জন্ম হয়। এর কিছুদিন পরে আমি জানতে পারি পল্লবী পরকীয়ায় লিপ্ত। ’৯৯ সালের গোড়ার দিকে, জুলির বয়স যখন তিন বছর, আমি একটা উড়ো চিঠি পাই, যেটাতে লেখা ছিলো জুলি আমার মেয়ে নয় –’

‘উড়ো চিঠির কথা আপনি বিশ্বাস করলেন? ডিএনএ টেস্ট করাতে পারতেন।’

‘পঁচিশ বছর আগের কথা। ঐ সময় ডিএনএ টেস্টের নাম শুনিনি। তবে, আমি পল্লবীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, তার প্রেমিক হাসনাত হলো জুলির সত্যিকারের বাবা। পরদিনই ছাদ থেকে পড়ে জুলি মারা যায়। লোকলজ্জার ভয়ে আমার মেয়ে হিসেবেই ওকে দাফন করেছি।’

‘পল্লবী আন্টি আপনাকে দোষারোপ করেনি?’

‘লাকিলি আমি সেদিন নারায়নগঞ্জ গিয়েছিলাম একটা ব্যবসায়িক কাজে। পল্লবী সন্দেহ করেছে আমি অন্য লোককে দিয়ে কাজটা করিয়েছি। তবে, কোনও মামলা-টামলা করেনি।’

‘বইয়ের লেখাটা আপনি ঐ সময়ে দেখেননি?’

‘না। আমি ’৯৪ সালেই বইটা পড়ে ফেলেছি। আর কখনও খুলে দেখিনি। বুকশেলফে জায়গা নেই বলে গত বছর অনেক পুরনো বইয়ের সাথে এটাও বিক্রি করে দিয়েছি।’

আরও কিছুক্ষণ কথা বলে সিরাজ সাহেব বিদায় নিলেন।

(৬)

অপু আমার জন্য কয়েকটি গল্পের বই নিয়ে এসেছেন। কিন্তু, আমি বই পড়ার মুডে নেই। সিরাজ সাহেবের কাছ থেকে যে তথ্যগুলি পেয়েছি, সেগুলো মনে মনে যাচাই বাছাই করতে শুরু করলাম।

নিশ্চিতভাবে বলা যায়, জুলির মৃত্যুটা দুর্ঘটনা নয়, হত্যা। কারণ, বইতে জুলিকে হত্যার কথা লেখা হয়েছে, যে-ই লিখুক।

আলোচনার স্বার্থে ধরে নেয়া যাক, বাচ্চাটা সিরাজের নয়, পল্লবীর প্রেমিক হাসনাতের। সেক্ষেত্রে, সিরাজ প্রতিহিংসার কারণে জুলিকে মারতে চাইতে পারেন। কিন্তু, তিনি বইয়ে সে কথা লিখতে যাবেন কেন? আনমনে লিখে ফেলেছেন? তাহলে তো ধরে নিতে হয় বইটা খোলা ছিলো এবং তার হাতে একটা কলমও ছিলো! এর সম্ভাবনা খুবই কম।

সিরাজ সাহেবের বর্তমান স্ত্রী সোনিয়া কি জুলিকে হত্যার জন্য দায়ী? তার বাবার বাড়ি আজিমপুরেই। ধরা যাক, তিনি জানতেন পল্লবীর সাথে সিরাজের ডিভোর্স হতে যাচ্ছে। তিনি নিজে সিরাজকে বিয়ে করতে চান। তিনি হয়তো ভেবেছেন, প্রভাবের কারণে সিরাজ জুলির কাস্টোডি পেয়ে যাবেন (বিশেষ করে যদি কোর্টে পল্লবীর পরকীয়া প্রমাণ করতে পারেন)। সেক্ষেত্রে জুলি সোনিয়ার ঘাড়ে চাপবে। তাই তিনি জুলিকে মারতে চাইতে পারেন, যাতে সিরাজ আর পল্লবীর সম্পর্কের কোনও চিহ্ন অবশিষ্ট না থাকে। কিন্তু, সোনিয়া নিশ্চয়ই বইতে জুলি-হত্যার কথা লিখে সিরাজকে ফাঁসাতে চাইবেন না!  

এবার ধরে নেয়া যাক, বাচ্চাটি সিরাজের। সেক্ষেত্রে হাসনাত ওকে মারতে চাইতে পারেন, কারণ পল্লবীকে তিনি বিয়ে করতে চান, কিন্তু জুলিকে উটকো ঝামেলা মনে করেন। সিরাজের অগোচরে তার বাসায় কি হাসনাতের যাতায়াত ছিলো? থাকাটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে, বইতে জুলি-হত্যার কথা লেখার সুযোগ ছিলো তার। সিরাজকে খুনের দায়ে ফাঁসিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য হয়তো তার ছিলো না। তবে, পুলিশ হাসনাতকে সন্দেহ করলে তিনি হয়তো বইয়ের লেখাটা কাজে লাগিয়ে সিরাজকে বলির পাঁঠা বানাতেন।

একটা খটকা থেকে যাচ্ছে। বাচ্চাটা সিরাজের হয়ে থাকলে পল্লবী কেন বললেন বাচ্চাটা হাসনাতের। এর একটা কারণ হতে পারে বাচ্চার কাস্টোডি। যদি ডিভোর্সের পর মা আবার বিয়ে করে, কোর্ট বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েকে বাবার কাস্টোডিতে দেয়। কারণ, কোর্ট মনে করে সৎ বাবার কাছে মেয়ে নিরাপদ নয়। পল্লবী মিথ্যা বলেছেন, যাতে সিরাজ বাচ্চাকে নিজের কাছে রাখতে চেষ্টা না করেন।  

ঘটনা যেভাবে ঘটেছিলো বলে আমার ধারণা: হাসনাত জুলির দায়িত্ব নিতে চাননি, কিন্তু পল্লবীকে এটা বুঝতে দেননি। বরং তাকে বুঝিয়েছেন, জুলির কাস্টোডি পেতে হলে সিরাজকে বিশ্বাস করাতে হবে যে বাচ্চাটা হাসনাতের। সেই অনুসারে সিরাজকে উড়ো চিঠি দেয়া হলো। সিরাজ পল্লবীর কাছে জানতে চাইলে তিনিও একই কথা বললেন।

হাসনাতের আসল উদ্দেশ্য ছিলো জুলিকে হত্যা করা। সবাই জুলিকে তার বাচ্চা মনে করলে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না। বইটিতে জুলি-হত্যার কথা তিনি লিখেছেন পল্লবীকে না জানিয়ে। তাই, হাসনাত জুলিকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করলেও পল্লবী সন্দেহ করেছেন সিরাজকে। কিন্তু, সিরাজের নামে মামলা করতে চাইলে হাসনাত তাকে নিবৃত্ত করেছেন। কারণ, পুলিশ কেঁচো খুঁড়তে গেলে সাপ বেরিয়ে পড়তে পারে।   

হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন পর পল্লবী আর সিরাজের ডিভোর্স হলো এবং পল্লবী হাসনাতকে বিয়ে করলেন। ২০০১ সালে সিরাজ আর সোনিয়ার বিয়ে হলো। বিয়ের পর Die for Love বইটি পড়তে গিয়ে লেখাটি সোনিয়ার চোখে পড়লো। এটা সিরাজ লিখেছেন ধরে নিয়ে তিনি লেখাটিতে পরিবর্তন আনলেন, যাতে তার স্বামী ঝামেলায় না পড়েন। কিন্তু, জুলির মৃত্যুর পর দুবছর পার হয়ে গেছে বলে বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলার দরকার মনে করলেন না।

অনেক চেষ্টা করেও ঘটনার ‍আর কোনও ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারলাম না।

পরদিন সিরাজ সাহেব আমার সাথে দেখা করতে এলেন সকাল দশটায়। তাকে বললাম, ‘আংকেল, আমি শিওর, জুলি আপনার মেয়ে। তাকে মেরেছে পল্লবীর প্রেমিক হাসনাত।’

অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন সিরাজ। তাকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতেই তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ‘আমি ডিএনএ টেস্ট করাবো,’ বলে হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে গেলেন।

দুদিন পর ক্লিনিক থেকে ছাড়া পেলাম আমি।

(শেষের কথা)

কয়েকদিন পর ডিএনএ টেস্টের রেজাল্ট পাওয়া গেল। প্রমাণ হলো, জুলি ছিলো সিরাজের ঔরসজাত সন্তান। কান্নায় ভেঙে পড়লেন সিরাজ আংকেল। বললেন, ‘এতদিন জুলিকে হাসনাতের অবৈধ মেয়ে মনে করে আমি কোনও মিলাদও পড়াইনি।’

পরদিন থানায় মামলা করলেন তিনি। আসামী করলেন হাসনাত আর পল্লবীকে। যেহেতু পল্লবী বলেছিলেন জুলি সিরাজের সন্তান নয়, হত্যাকাণ্ডে তিনি পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছেন বলে ধরে নেয়া যায়।

মামলায় অন্য দু’একজনের সাথে আমাকেও সাক্ষী করা হলো। Die for Love বইটি এবং ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

পঁচিশ বছর ধরে অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা জুলির কবর ভগ্নদশা থেকে রক্ষা পেলো। মিলাদ মাহফিল আর কাঙালী ভোজের আয়োজন করা হলো।

প্রতিটি অনুষ্ঠানে মধ্যমণি (বলতে পারেন মধ্যমা) হিসেবে আমাকে থাকতে হয়।

ক্ষতিপূরণ আর পুরস্কার হিসেবে আমি কী পেলাম? শুধু এটুকু বলি, সিরাজ আংকেল খুবই উদার মনের মানুষ।  

মাঝে মাঝে ভাবি, Die for Love কথাটি জুলির জন্য কী নির্মমভাবে সত্যি হলো! হাসনাত আর পল্লবীর ভালোবাসার বলি হতে হলো মেয়েটিকে।  

(শেষ)

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪

জাফর আহমেদ খান

প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪