জীবনীশক্তি, এমন একটা শক্তি যেটা জীবনের প্রতিটা স্তরে, সবরকম পরিস্থিতিতে আপনাকে শেখাবে, আপনাকে জানাবে আপনি কতটা ভালো আছেন। আপনার জীবনের প্রতি আপনার কেন কোনো অভিযোগ থাকতে নেই। আসলে মনের মধ্যে হাজারো অভিযোগ পুষে রেখে তো আর জীবনে ভালো থাকা যায় না। যখন কোনো ভালো কিছু আমরা পাই তখন তো এই প্রশ্নটা মনে আসে না আমাদের!! আমরা তো একটি বার ভাবিও না যে “হোয়াই মি?…” কেন এই ভালো কিছুটা আমার সাথেই ঘটলো, কেন আমিই পেলাম? তাহলে যখন খারাপ কোনো কিছু ঘটে আমাদের সাথে, তাহলে তখন কেন? কেন তখন আমরা অভিযোগ করবো? কেন প্রশ্ন করব যে “হোয়াই মি?…”
এইযে কথাটা, ছোট্ট একটা কথা। কিন্তু তার মাহাত্ম্য অসীম। একটা মানুষের সমস্ত দুঃখ দূর করে দেওয়ার মতো শক্তি এই কথাটার মাঝে আছে বলে আমার বিশ্বাস। আর জীবনের এই অতীব সত্য কথাটা সেইদিন আমার মনে সত্যিই দাগ কেটেছিল।
কথাটি মুরশীদা ম্যাডামের; কথাটির সাথে যখন তিনি নিজের জীবনের গল্পটুকু বললেন, হয়তো সেই গল্পটুকুর জন্যই কথাটা এইভাবে গেঁথে আছে মনে।
পূজার ছুটির শেষ শেষ সময়ে; ১৯ অক্টোবর হঠাৎ জাফর স্যারের মেইল এলো। মেইলটা এমন ছিলো যে, আমাদের ১০১ কোর্সটা লুৎফর স্যারের পরিবর্তে এখন থেকে নিবেন মুরশীদা খানম ম্যাডাম। ম্যাডামের সাথে তার আগে আমাদের দুইদিন আলাপের সুযোগ হয়। প্রথম দিন আমাদের অরিয়েন্টেশন এ ম্যাডামের উপস্থাপনা দিয়ে আর পরে প্যাপাইরাসের পঁচিশ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে। এই দুইদিনে আমরা প্রথম বর্ষের সবাই এটা খুব ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছিলাম যে ম্যাডাম অনেক বেশি ডিসিপ্লিনড, একটু বেশিই কড়া ধাঁচের। সবার মনে একটু ভয় ভয় কাজ করছিলো, ম্যাডাম এর ক্লাস পাচ্ছি আমরা প্রথম বর্ষেই(উনি সাধারণত চতুর্থ বর্ষে ক্লাস নিতেন)।
কে জানতো তখন! যাঁকে নিয়ে এতো ভয়ে ভয়ে ছিলাম, সেই মুরশীদা ম্যাডাম ই সবার সবচেয়ে প্রিয় একটা মানুষে পরিণত হবে! সত্যিই, আমরা কেউই এটা জানতাম না। এইযে যাঁকে আমরা খুব রাগী, কাঠখোট্টা একটা মানুষ ভেবেছিলাম, সেই তিনি আমাদেরকে কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন উপভোগ করতে হবে; পড়াশোনার পাশাপাশি যেকোন ধরনের প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে- এসব নিয়ে উৎসাহ দিতেন, অনুপ্রাণিত করতেন, আর মাঝে মাঝে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সময়টার কথা বলতেন সংক্ষেপে।
“তোমরা পরিসংখ্যান এ পড়তে এসেছ, জানি কেউ স্বেচ্ছায় আসোনি। কারোর স্বপ্ন ছিলো হয়তো মেডিকেল বা বুয়েট। সেই স্বপ্ন ভেঙ্গেই এই পরিসংখ্যানে তোমাদের পা রাখা। তবে এসেই যখন পরেছো, তাহলে মেনে নাও পরিসংখ্যানে তোমার জন্য ভালো কিছু রেখেছেন আল্লাহ। পরিসংখ্যানকে ভালোবেসে দেখো, হতাশ হবা না। আর হ্যাঁ, জীবনের প্রতি কোন অভিযোগ রেখো না।”
আমার ধারণা, ক্লাসের প্রতিটা মানুষের পজিটিভ থিংকিং পাওয়ারটা একটু হলেও বেড়েছে মুরশীদা ম্যাডামের মতো একটা মানুষের সংস্পর্শে এসে।
কিছু কথা,
“আমরাতো চাইলে এখানেও (ক্লাসরুমে) ছবি তুলতে পারি।
সেই ছবিটা আর আমাদের তোলা হলো না, সেই সুযোগটা আর পেলাম না। আফসোস থেকে যাবে।
শীতের ছুটির আগে শেষ ক্লাসে,
“তোমরা ভালো থেকো, নিজের যত্ন নিও। খুব কম মানুষই নিজের যত্ন নেয়, তোমরা নিজেদের যত্ন নিও। বেঁচে থাকলে ছুটি শেষে দেখা হবে। উইন্টার ভ্যাকেশন টা ভালো ভাবে কাটাও, পরীক্ষার জন্য প্রিপারেশন নাও। তোমরা তো জানো, প্রথম পরীক্ষাটাই কিন্তু আমার। ঠিক আছে, যাও।”
এটাই শেষ। আর কোন কথা হলোনা আামাদের উনার সাথে। ম্যাডামের পরীক্ষায় কিভাবে কিভাবে খাতায় উত্তর করলে ম্যাডামের মন মতো হবে, ভালো নাম্বার পাওয়া যাবে, সেই চিন্তাকে স্তিমিত করে দিল ১৪ ডিসেম্বর সকালটা। থমকে গেলাম! আমি কি ভুল কিছু পড়ছি? বা ভুল কিছু দেখছি? আমার তো এখনো খাতায় ম্যাডামের সাইন পাওয়া হয়নি একটাও, সেই সাইন নেওয়ার সুযোগটা কি আর আমি পাবো না? আর কি ম্যাডামের উৎসাহমূলক কোন কথা শোনা হবে না? ক্লাসে হাসার জন্য দাঁড় করানো হবে না? আমাদের ব্যচের ছেলেরা যে একটু বেশিই কথা বলে এটা বলে আর মেয়েদের পক্ষ নেওয়া হবে না? আরও কত কি যে হবেনা, যা হয়তো সামনের চারটা বছরে হওয়ার কথা ছিলো।
ভাগ্য করে পেয়েছিলাম ম্যাডামের ক্লাস। আমরা ৭৩ ব্যাচ সত্যিই অনেক বেশি সৌভাগ্যবান। এই মানুষটাকে না জানাটাকে আমি দুর্ভাগ্য বলেই মনে করি। যদিও খুব বেশি জানার আাগেই তারাটা খশে গেলো, আরও কতটা জানা বাকি রয়ে গেল কে জানে! আমাদের কাছে মুরশীদা ম্যাডাম মানে দুইটা মাস, বিশটা লেকচার, একটু উৎসাহ, উদ্দীপনা আর আজীবন মনে রাখার মতো কিছু উপদেশ।
ম্যাডাম, আপনি হয়তো আর নেই; সেই ট্রান্সপারেন্ট ফাইলটা হাতে, হয়তো আর ক্লাসে আসবেন না। করিডোরে আপনাকে দেখে সালাম দেওয়া হবে না, আপনি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করবেন না যে, কেমন এনজয় করছি ইউনিভার্সিটি লাইফ। কিন্তু ম্যাডাম, যে জীবনবোধ আপনার কাছ থেকে আমরা পেয়েছি, সেটা সত্যিই অমূল্য। আজীবন সাথে নিয়ে যেন চলতে পারি এই প্রার্থনাই করবো।
- মাহবুবা মিতুhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%ac%e0%a7%81%e0%a6%ac%e0%a6%be-%e0%a6%ae%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%81/বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ১৪, ২০২৪
- মাহবুবা মিতুhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%ac%e0%a7%81%e0%a6%ac%e0%a6%be-%e0%a6%ae%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%81/বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১২, ২০২৪