প্রতিবিম্ব
(১)
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রূপা। আয়নার প্রতিবিম্ব জিজ্ঞেস করল,
-কেমন আছ রূপা?
-এইত….
-এটা কোন উত্তর হল? বলো, ভালো না খারাপ?
-মাঝামাঝি!
-নাহ! তুমি মানুষ হবে না!
-আমি তো মানুষই! মানুষ হতে হবে কেন?
-এই কার সাথে কথা বলিস? মায়ের কণ্ঠ।
-কেউ না মা।
-বিকেলে নিলয়, মিতুরা এলো। দরজাই খুললি না। আর এখন একা একা বকবক করছিস?
-না মা… খুব ক্লান্ত। একটু ঘুমাবো।
-কিসের ক্লান্ত? সারাদিন তো ঘরেই বসে থাকিস।
-আহ! মা যাও না… একটু একা থাকতে দাও।
মা ভাবেন, আর কত একা থাকবে মেয়েটা।
ছাদে রোদ পোহাতে এসেছে রূপা। শীতের মিষ্টি বিকেল। সামনের বিল্ডিং এর পাজি ছেলে ফয়সাল অন্ধ মাকে ধরে ধরে হাঁটাচ্ছে। এই দুই বছর আগেও বখাটে হিসেবে বিখ্যাত ছিল। অথচ আজ… মায়ের অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে যেন নতুন জন্ম হল ছেলেটার। এখন ছোট একটা জব করে আর বাকি সময় পুরোটাই মা কে দেয়। কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায় না। রূপা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। একবারও তাকালো না। মাকে আকাশের রঙ, মেঘের অবস্থান বোঝাচ্ছে।
কী অদ্ভুত! সময় সব পারে। আচ্ছা? সময় কি আবীরকে ভুলিয়ে দেবে? ভুলিয়ে দেবে তার ভেতরে তিল তিল করে বেড়ে ওঠা ছোট্ট প্রাণ, যে পৃথিবীর আলো বাতাস স্পর্শ করতে পারল না… তাকে ভুলিয়ে দিতে? পারবে?
-কীরে… কী দেখিস অমন করে? পিছন থেকে মা জিজ্ঞেস করলেন।
-মা! এই পা ব্যথা নিয়ে ছাদে উঠলে কেন?
-নিপাকে বললাম তোকে ডেকে আনতে। আসল না। কী করব? এত অলস হয়েছে মেয়েটা!
-কী যে বল না মা!
-ও কী বলে জানিস? তোর বাবা আর আমি যা টাকা জমিয়েছি কে খাবে এত? এজন্য ও টাকা খরচ করতে আমাদের সাহায্য করে!
-ঠিকই তো বলেছে মা। আমার কোন বাচ্চা নেই। যা আছে সব তো ওরই।
-আহা! এভাবে ভাবছিস কেন?
-নিচে চল মা। কফি খাব।
-আচ্ছা চল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের সাথে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন মা। মেয়ের বিষণ্নতা বুঝেও নিরুপায় তিনি।
(২)
নিপার কলেজে এসেছে রূপা। ক্লাস পরীক্ষার রেজাল্ট নিতে। খুব কড়া নিয়ম। রেজাল্ট কার্ড দেখে সই করে জমা দিতে হবে।
হঠাৎ দেখে ফয়সাল। এক প্রভাষকের সাথে কথা বলছে। কথা শেষে ঘুরেই দেখে রূপা দাঁড়িয়ে আছে। ও রূপাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে। যে যন্ত্রণা দিয়েছে ও এলাকার মেয়েদের- সে জন্যই হয়ত মায়ের আজ এই অবস্থা। আল্লাহ এভাবেই শাস্তি দিয়েছেন। সবার সাথেই কথা বলেছে ফয়সাল। স্যরি বলেছে। শুধু রূপাকেই কিছু বলতে পারেনি। কারণ রূপা ছিল বিপরীত বিল্ডিং এ। ওকে সবচেয়ে বেশি জ্বালিয়েছে। রূপা গোসল সেরে ভেজা চুলে বারান্দায় এলেই তাকে নিয়ে ছড়া কাটত। শিষ দিত। অনেক বাজে কথাও বলেছে। রূপা খুব রেগে গেলেও কেন যেন কখনো তীব্র প্রতিবাদ করত না। ও মেয়েটাই এমন। খুব নরম মনের।
-কেমন আছেন?
-বাহ! আপনি করে বলছ!
-না, মানে!
-এখানে কী কাজ?
-ঐ একটা চাকরির চেষ্টা করছি।
-একটা জব তো আছেই।
-ও তে চলছে না। মায়ের চিকিৎসার খরচ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
-হুম। সবচেয়ে সস্তা কী জিনিস জানো?
-কী?
-মানুষের মন!
-ভুল বললেন। যার মন অতি আরাধ্য সেই মন অমূল্য।
-বাপরে! কঠিন বাংলা!
লাজুক হাসি হাসল ফয়সাল।
-আমি আসি। অফিসে লাঞ্চ ব্রেক প্রায় শেষ।
-কিছু তো খেলে না।
-নাহ! রোজ রোজ বাহিরে খাওয়ার পয়সা কোথায়?
চলে গেল ফয়সাল। কত পরিবর্তন ছেলেটার!
হঠাৎ ফিরে এসে বলল,
-আচ্ছা তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে কোনদিন?
-কিসের ক্ষমা?
-এই যে স্কুলে থাকতে কত বিরক্ত করতাম।
-সেসব কবেই ভুলে গেছি।
-অনেক অনেক ধন্যবাদ।
-তবে একটা শর্ত আছে।
-কিসের শর্ত?
-পূরণ করতে পারবে?
-বলেন, চেষ্টা করব।
-এই আপনি তুমিটা ছাড়। আমরা সমবয়সী।
-ওহ! আমি তো ভেবেছিলাম কী না কী! বেশ তুমি করেই বলব। আজ চলি…
অনেকদিন পর কারো সাথে এত কথা বলল রূপা। বাহিরে বেরিয়েছে দুই মাস পর। রুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আজ নিজেকে খুব অন্যরকম লাগছে। কানের দুলটা খুলে ড্রেসিং টেবিলে রাখতেই মনে পড়ল এই দুলটা তো আবীরের দেয়া। সব জামার সাথে ম্যাচিং চুড়ি আর কানের দুল কিনে দিত। সেবার দূর্গা পূজার মেলা থেকে এনেছিল এই মাটির কানের দুলটা। সাথে অসংখ্য চুড়ি বিভিন্ন ডিজাইনের। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল রূপা।
কোথায় তুমি? আবীর? কেন চলে গেলে? তোমরা দুজন আমাকে এভাবে কেন ফেলে গেলে? আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব? বল? আবীর বল?
মা দরজায় দাঁড়িয়ে মেয়ের আর্তনাদ শুনছেন আর চোখ দিয়ে অনবরত জল ঝরছে।
(৩)
রূপার সমস্ত গহনা ফেরত দিতে এসেছে আবীরের ছোট বোন আর বড় ভাবী। দুজনের মুখ বেজার।
-ভাবী বললেন, সব বুঝে পেলে তো? আবার বলো না আমরা মেরে দিয়েছি।
রূপা মাথা নিচু করে বসে আছে।
-আবার বিয়ে করার জন্য এত পাগল হলে কেন? ননদের প্রশ্ন। ভাইয়ের কবর এখনো শুকিয়ে পারেনি!
রূপা কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। মুখ নিচু করে শুধু কেঁদেই চলেছে।
-এক্সিডেন্ট করে যখন হাসপাতালে ভর্তি হলে তোমার হাসপাতালের বিলটা তো তোমার ভাসুর দিয়েছে… সেটা কি আমরা ফেরত চাইছি? ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন ভাবী।
এবার নিপা জবাব দিল,
-কত টাকা খরচ হয়েছে বলেন। আমরা শোধ করে দিচ্ছি। তাও এত কটু কথা বলবেন না।
-তোমার বোন এত গহনা গহনা করছে কেন সে তো আমরা বুঝি। আমাদের চোর মনে করে।
-না ভাবী। আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। ঐ গহনা বিক্রির টাকা দিয়ে একটা সৌখিন জিনিসের দোকান খুলতে চাই।
-হাহ! সব বুঝি। দুদিন বাদেই দেখব কারো গলায় ঝুলে পড়েছ।
-তাতে আপনাদের এত সমস্যা কোথায়? এত অল্প বয়সে বিধবা হয়েছে আপু। বাচ্চাও নেই। বিয়ে করলে সমস্যা কী? ফালতু কথা বাড়াচ্ছেন কেন?
চেঁচিয়ে উঠল নিপা।
-এই থাম নিপা। আমি চাইনা এসব নিয়ে আমার মেয়েটাকে কষ্ট পেতে হয়। মা জবাব দিলেন।
-বেশ তাহলে রূপার নামে করা ফ্ল্যাটটা ফেরত দাও!
-কেন ফেরত দেবে? ওর স্বামীর জিনিস? নিপার ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর।
-ওর স্বামীকে তো আমরাই বড় করেছি।
সহ্য করতে পারল না রূপা। এলিয়ে পড়ল সোফায়।
নিপা আর মা ছোটাছুটি করতে লাগলেন অসহায়ের মত।
(৪)
হাতের কাজ করা শোপিস, সুতির শাড়ি, চাদর, বালিশের কভার, বাচ্চাদের জামার ছোট্ট শো রুম খুলল রূপা। একা হাতে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। হিসাব নিকাশ বুঝে উঠতে সমস্যা হচ্ছে। হঠাৎ দেখে দরজায় ফয়সাল দাড়িয়ে।
-আসব?
-হুম প্লিজ এসো।
-চমৎকার সাজিয়েছ দোকানটা।
-ধন্যবাদ। আমার অনেকদিনের স্বপ্ন। এমন একটা দোকান খোলার।
-সুন্দর হয়েছে।
-চা-কফি কিছু খাবে?
-খাওয়া যায়।
-তুমি ক্যাশে একটু বসো। আমি বানাচ্ছি।
কাউন্টারের পিছনে ছোট একটা টেবিল তাতে চায়ের সরঞ্জাম আর ইলেকট্রিক কেটলি রাখা।
-আচ্ছা। তারপর বল…. কেমন চলছে দিন কাল। কলেজের জবটা হল?
-না। এত সহজ নাকি? আমার তো মা ছাড়া কেউ নেই। মন্ত্রী, সচিবের ফোন আসে না আমার ভাইভার সময়।
-কী করবে তাহলে?
-সেটাই তো ভাবছি।
-এক কাজ কর, আমার দোকানে পার্ট টাইম বসো। যদি আপত্তি না থাকে।
-না না আপত্তি নেই।
-বেতন কিন্তু খুব বেশি দিতে পারব না।
-না না, সেটা সমস্যা হবে না।
-এত ভদ্র হলে কবে?
-নাহ! কিসের ভদ্র? বিকেলে ছাত্র পড়িয়ে আর কয় টাকা পাই। তুমি তার থেকে বেশিই দেবে আমার বিশ্বাস।
-তাহলে কাল থেকে কাজে আস।
-তুমি বললে আজই শুরু করি?
-না। আজ তুমি গেস্ট।
-আচ্ছা।
গল্পে গল্পে চমৎকার একটা বিকেল কাটায় রূপা আর ফয়সাল। ছোট বেলার দুষ্টুমি, বড় বেলার চাওয়া পাওয়ার হিসেব নিকেশ সবকিছু নিয়ে গল্প হলো। দোকান বাসা থেকে সামান্য দূরত্বে, হাঁটা পথ। ফয়সালের সাথে কথা কথা বলতে বলতে নিমেষে চলে এলো রূপা। আর রাতে ফেরার চিন্তা রইল না। মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব দেখলেন। ফয়সাল রূপার গেট খুলে চোখের আড়াল হওয়া অব্দি তাকিয়ে ছিল। মা নতুন আশায় বুক বাঁধলেন।
(৫)
একবছর হতে চলল রূপা আর ফয়সাল মিলে শো রুমটা চালায়। এখন নিজস্ব ভাবে গ্রামের মহিলাদের দিয়ে হাতের কাজ করিয়ে আনে ফয়সাল। ছোট চাকরিটা ছেড়ে মন লাগিয়ে এই কাজটাই করছে। ঈদ, পূজা তে বড় বড় দোকানের অর্ডার সাপ্লাই দিচ্ছে।
বিকেলে কাজের ফাঁকে দুজন কফি খেতে বসেছে,
-আমার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়।
রূপা বলল।
-কী প্রশ্ন?
-তুমি এখানেই কেন এলে কাজ নিতে?
-থাক না ওসব কথা।
-না থাকবে কেন? বল।
-বেশ…. যেদিন গহনা ফেরত দিতে এসেছিল দুজন মহিলা, ঐদিন আমি তোমাদের ছাদ থেকে মায়ের জন্য তুলসি পাতা পেড়ে আনছিলাম। সব শুনেছি। তারা কী ভয়ংকর অপমান করেছিল তোমাকে। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে। তখনই মনে মনে শপথ নিয়েছিলাম। যে করেই হোক দোকানটা দাঁড় করাবোই। ছোটবেলার ঐ দুষ্টুমিগুলো বড় বেলাতেও আমাকে ভোগাবে আমি বুঝিনি। সব মেয়ে রেগে গিয়ে গালি দিত আমি খুব মজা পেতাম। কিন্তু তুমি কিছুই বলতে না। তারপর আমার চোখের সামনে একদিন বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি চলে গেলে। সেদিন লাল শাড়িতে তোমাকে দেখে আমি বুঝেছিলাম কী হারিয়ে ফেলেছি দুষ্টুমি করতে করতে। তারপর আবার তোমার সঙ্গ পাওয়ার সৌভাগ্য হল…
-ওহ! করুণা করলে আমায়?
রূপার চোখে পানি। হঠাৎ ফয়সাল হাত বাড়িয়ে রূপার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
-যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কখনো করুণা করা যায় না। রূপা ফয়সালের হাত দুটো চেপে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠল।