fbpx

ছয়টা বেজে বায়ান্ন মিনিট

পর্দার ফাঁকে আলো এসে পুরো রুম ভরে আছে। ঘড়ির কাঁটায় খুব বেশি বেলা গড়ায়নি। হুমড়ি খেয়ে উঠে বসলো পরশ। মোবাইলে চেক করে নিলো, শুক্রবার সকাল সাতটা বেজে ছাব্বিশ মিনিট। হুমড়ি খেয়ে আঁতকে উঠার মতো কিছু হয়নি আপাতত। বন্ধের দিন, আরো কিছুক্ষণ শুয়ে কাটিয়ে দেওয়া যেত। তবে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে বেশি সময় লাগলো না। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো তার বাসাটাই চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে। আঁটসাঁট রুমের জায়গায় বিশাল বড় এক রুম, সামনে ওয়াশরুমের স্লাইডিং ডোরটা হালকা খোলা। রুমের আকাশী-নীল দেয়ালের জায়গায় অফ-হোয়াইট দেয়াল। তীব্র মাথা যন্ত্রণা বাস্তবতা ভুলিয়ে দিচ্ছে যেন!

স্লাইডিং ডোরটা পুরোটা খুলে গেল। জানালার থেকে দূরত্ব বেশি থাকাতে স্পষ্ট কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মাথা যন্ত্রণাতে চোখের দৃষ্টিও কমে এসেছে যেন। আধখোলা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে পরশ। পরক্ষণে আবছা আলোয় ভেজা শরীরে বের হয়ে আসলো একটা মেয়ে। একটা সাদা তোয়ালে দিয়ে যথা সম্ভব ঢাকা আছে শরীরটা। মুখটা দেখল পরশ, ভেজা চুলে কামনাময়ী এই মুখটা তার পরিচিত, অতিপরিচিত। সুহানা তার সামনে এসে দাঁড়ালো  একগাল হাসি নিয়ে নিজ ঢঙে সুপ্রভাত জানালো। অবশেষে কিছুটা হালকা হলো পরশ।

***

গাড়ি পার্কিং থেকে বের করে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে পরশ। এক কলিগের বাসায় ইনভিটেশন আছে আজ সন্ধ্যায়। গত দশ মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেও সুহানার দেখা মেলেনি এখনো। এখানেই সন্ধ্যা নেমে এসেছে। প্রায় ঘন্টাখানেকের পথ, জ্যাম থাকলে তো আরো বেশি। এতো কিছুর পরেও বিরক্তি আসছে না পরশের। হয়তো সুহানার মতো লাস্যময়ী জীবনসঙ্গী থাকলে জীবনে বিরক্তিও কম আসে, মন মেজাজ ফুরফুরে থাকে। অন্তত পরশের জীবনে এখন তাই হচ্ছে।

সুহানা আর বেশি সময় অপেক্ষা করায়নি। হাতে সাদা ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে স্লিভলেস ব্লাউজে সাদা শাড়ি আর খোলা চুল। চোখ ফেরানো দুষ্কর। মুখে চাপা হাসি নিয়ে পরশের সামনে এসে দাঁড়ালো। দেরি হওয়ার কারণ দেখানোর কোনো উদ্দীপনা নেই তার। অবশ্য প্রয়োজনও নেই এসবের। সুহানার উপস্থিতি পরশের সব ক্লান্তি মুহূর্তেই কেড়ে নিলো। সুহানা হয়তো তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতো অপেক্ষার ক্ষতিপূরণ হিসেবে, কিন্তু রাস্তায় এতো মানুষের মধ্যে আর কাছে আগানোর সুযোগ হয়নি। ঝটপট গাড়িতে বসে স্টিয়ারিং হাতে নিলো পরশ। ব্ল্যাক কালারের টয়োটা প্রিমিও। গিয়ার শিফট করে মেইনরোডে বের হয়ে পড়লো সে। পারলে তো এখন টপগিয়ারে চালিয়ে নিয়ে যেত পুরো পথ, সুহানা তো পাশের সিটেই আছে!

***

সপ্তাহের এই একটা দিন অন্তত শহরটাকে এখনো বাসযোগ্য মনে হয়। যেসব রাস্তায় একটানা দশ-বিশ-তিরিশ মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা লাগে, আজকে একটানে বের হয়ে যাওয়া যাচ্ছে। এমন ফাঁকা রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা চালিয়ে গেলেও ক্লান্তি আসবে না। আর বোনাস হিসাবে পাশে সুহানা তো আছেই। সাধারণত ড্রাইভিং এর সময় কথা বলা পছন্দ না পরশের। প্রতিদিনের যানযট ঠেলে মেজাজও খিটখিটে থাকে। কিন্তু আজকে খুব বেশি করে সুহানার সাথে গল্প চালিয়ে যেতে মন চাচ্ছে। লো ভলিউমে বেজে চলছে হ্যাডি ওয়েস্টের ক্ল্যাসিক্যাল ‘ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস্’। গানের লিরিক্সটা সময়টার সাথে যাচ্ছে না। পরশের আপাতত বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। এমন পথে সুহানার সঙ্গ ছেড়ে বাসার ভেতর আটকে থাকারও কোনো মানে হয় না! তাও গানটা চেঞ্জ করারও ইচ্ছে হচ্ছে না। গানের তালে মুখ চলছে তার।

ড্যাশবোর্ডে থাকা ক্লকের দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো একপলক। সময় ছয়টা বেজে বায়ান্ন মিনিট। ডিসেম্বরের শহরে শীত না আসলেও দিন ছোট হয়ে এসেছে। এখনই যেন রাত হয়ে যাওয়ার উপক্রম। তবে গত দুদিন কিছুটা ঠান্ডা বেড়েছে। আবহাওয়া অফিসের সূত্রমতে সামনের সপ্তাহে আরো কমবে তাপমাত্রা। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বরাবর বয়ে যাবে শৈত্যপ্রবাহ, যার কিছুটা আঁচ ঢাকাতেও পড়বে। আরো এক ঝলক চোখ রাখলো ড্যাশবোর্ডে। ফুয়েল ইন্ডিকেটর একদম তলানিতে এসে লেগেছে। ফেরার পথে কোনো ফিলিং স্টেশনে থামতে হবে। রানিং স্পিড ৭০~৭২ এর মতো। সবই শুক্রবারের ফাঁকা রাস্তার কল্যাণে।

গান শেষ হওয়ার আগেই সুহানা গান চেঞ্জ করে দিলো। এবার চলছে চেইনস্মোরের ‘ক্লোজার’। শব্দগুলো কানে বেশ জোরে বাজছে। সুহানার মর্জি ভেবে সেদিকে আর কর্ণপাত না করে রাস্তার দিকে মনযোগী হলো পরশ। প্রোগ্রাম সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হওয়ার কথা। পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে এটা মোটামুটি নিশ্চিত। এখন যতোটা তাড়াতাড়ি গিয়ে সবার সামনে দাঁড়ানো যায় আরকি! পরশ এক্সিলারেট করলো আরো। রাস্তা প্রায় পুরোটায় ফাঁকা। অন্যসব শুক্রবারেও এতোটা ফাঁকা পাওয়া যায় না। পরশও তাই সুহানার থেকে নজর সরিয়ে একদমে চালিয়ে গেল।

স্পিডোমিটারে নজর দিল পরশ। গতি ১২০ এর উপরে। ঢাকার রাস্তাঘাটে ১২০ এ গাড়ি চলছে এই কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে দিলেও না। তাও পরশের আজকে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। চোখের সামনে পুরোটা রাস্তা এখনো ফাঁকা। পুরো শহরটা যেন তার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। গানটাও শেষ। আবার বাজতে শুরু করলো গানটা। এটা পরশের পছন্দের গানগুলোর মধ্যে একটা। চার মিনিট বাইশ সেকেন্ডের। এইপুরোটা সময় গাড়ি একশোর উপরেই চলেছে। সুহানাও নীরবতা পালন করছে পাশে বসে। শুরুর আবহ অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে এই অল্পসময়ে।

চোখ আবার গেল ড্যাশবোর্ডে। সময় ৬:৫২। ছয়টা বেজে বায়ান্ন মিনিট? পরশ আরেক বার তাকালো। না, ভুল দেখছে না। মোবাইলের স্ক্রিন অন করে সময়টা মিলিয়ে নিলো। এখানেও ৬:৫২। একটু আগে কতো ছিলো তাহলে? পরশের মনে পড়ছে এটাইতো ছিলো। সময় বাড়েনি তাহলে। নাকি তার ভুল। হয়তো ভুলে গিয়েছে আগের সময়টা। সুহানাকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। কিন্তু এইসব আজগুবি কনফিউশান সুহানাকে না বলাই ভালো। এসব বললে পাগলও ভাবতে পারে। বরং একটা বড় দম ফেলে বাকিটা পথ চালিয়ে যাওয়া ভালো। রাস্তা আর বেশি বাকি নেই।

চোখটা বারবার ড্যাশবোর্ডের ঘড়িটার দিকে যাচ্ছে। এক মিনিটের জন্য অপেক্ষা কতোটা দীর্ঘতর হতে পারে! মিনিটের ডিজিট বায়ান্নতেই স্থির হয়ে বসে আছে। মোবাইলের স্ক্রিনেও সময় ৬:৫২! ব্যাপারটা সামান্য কিছু হিসেবে ভেবে নেওয়া যেত, কিন্তু এতোটা সময় যাওয়ার পরেও রাস্তা শেষ হচ্ছে না। আরো আগেই তো তাদের গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা। পরশ মনে করতে পারছে না কোথায় যেতে হবে তার। এখন কোথায় আছে তাও চিনছে না। শুধু ফাঁকা রাস্তা আর দুপাশে সারিবদ্ধ নিঃসঙ্গ ল্যাম্পপোস্ট। এই শীতের সন্ধ্যায়ও ঘেমে যাচ্ছে পরশ। পিনপতন নীরবতা যেন অন্তিম পথটুকু দেখাচ্ছে তাকে। হার্টবিটের শব্দ কানে বাজছে জোরেজোরে। মাথা ব্যাথাটা আবার তীব্র হয়ে উঠলো। এমন  তীব্র ব্যাথায় মাথাটা কেটে ফেলতে পারলে হয়তো শান্তি লাগতো। চোখও খুলে রাখা যাচ্ছে না। গাড়ির গতি বেড়েই চললো। স্পিডোমিটারের কাঁটা ১৬০ ছাড়িয়েছে। পাশে সুহানা নির্লিপ্ত হয়ে বসে আছে। কোনো কিছুই যেন স্পর্শ করছে না তাকে।

হঠাৎ চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসলো পরশের। যেন সব ল্যাম্পপোস্ট একসাথে অফ হয়ে গেল। অন্ধকার নাকি সে আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না চোখে ? তবুও গাড়ির গতি কমালো না পরশ। সে জানে এই রাস্তায় এখন সোজা যেতে হবে। কোনো টার্ন নেই, স্পিড ব্রেকার নেই, না আছে অন্য কোনো গাড়ি। শুধু নাক বরাবর চালিয়ে যাওয়া লাগবে।

হঠাৎ সামনে থেকে আসা তীব্র আলো চোখ ঝলসে দিলো পরশের। গাড়ির হেডলাইটের আলো তাদের সামনে বরাবর। কিছু আঁচ করতে পারার আগেই সপাটে হেভিওয়েট প্রিমিও আছড়ে পড়লো মুখোমুখি থাকা আরেকটা গাড়ির উপর। শেষ মুহূর্তেও স্টিয়ারিং ছাড়ে নি পরশ। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। রাস্তা থেকে বহুদূরে ছিটকে পড়লো গাড়ি-সমেত। জীবনের শেষ কয়েকটা সেকেন্ড হয়তো দেখছে সে। পাশে তো সুহানা! তাকালো সেদিকে। সুহানার দৃষ্টি আগে থেকেই পরশের উপর। শান্ত গলায় বললো, “পরশ”। ড্যাশবোর্ডের ঘড়িটায় সময় তখন ছয়টা বেজে বায়ান্ন মিনিট।

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ২০১৯ - ২০২০

কৃতি বাঁধন

সেশনঃ ২০১৯ - ২০২০