fbpx

উপসম্পাদকীয় – ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ফেব্রুয়ারি মাসের আগমন মানেই ভাষা নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বা্স! তাছাড়া এ মাসেই ফাগুনের আগুন লাগা বসন্ত!! তাই বসন্তের ছোঁয়া আমাদের মন জুড়ে!!!

বসন্তের আগে এবার তীব্র শীতকে অনেকটা উষ্ণ করে তুলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাম্প্রতিক ‘শরীফা’ বিতর্ক। ‘শরীফা’ বিতর্কের উৎস নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী ৭ম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান – অনুশীলন বই এর শরীফার গল্প থেকে। আর এই বিতর্কের সূত্রপাত মূলতঃ এ বিষয়কে কেন্দ্র করে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক প্রকাশ্যে পাঠ্যপুস্তক ছেঁড়ার মাধ্যমে। এ ঘটনার পর আমাদের প্রযুক্তিনির্ভর যুব সমাজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দু’টা বিষয়ে সোচ্চার হয়ে উঠে – এক. ‘শরীফার গল্প’ সম্বলিত পাঠ্যপুস্তক ছেঁড়ার ইভেন্ট খুলে জনগণকে তাতে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে তোলার উদ্যোগ এবং দুই. ‘শরীফার গল্প’-কে ট্রল করে বিভিন্ন ভিডিও/টিকটক তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা।

এ ঘটনাগুলো ভেবে দেখলে আমাদের বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাশীলতার দুর্বলতা প্রকাশ পায়। শরীফার গল্প-তে যে বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে সেটা হচ্ছে জৈবিক লিঙ্গ পরিচয় (Sexual Identity) ও সামাজিক লিঙ্গ পরিচয় (Gender Identity)-এর মধ্যকার অসঙ্গতি। এই অসঙ্গতি অনেক সময় ব্যক্তি বিশেষে প্রাকৃতিকভাবে ঘটতে পারে যার কারণ জানা যায় না। আর এ ধরনের অসঙ্গতি সামাজিক ভাবে একজন ব্যক্তিকে তার স্বীয় সত্ত্বা প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠায় ভীষণ ভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এক্ষেত্রে ব্যক্তির মানসিক সুচিকিৎসার মাধ্যমে এবং পারিবারিক ও সামাজিক নিবিড় পরিচর্যায় এই অসামঞ্জস্যতা দূর করা সম্ভব। তবে Transgender এর ক্ষেত্রে যেটা হয় সেটা হচ্ছে কোন ব্যক্তির জন্মগতভাবে জৈবিক লিঙ্গের বিপরীত মানসিক লিঙ্গ পরিচয় গড়ে উঠে; অর্থাৎ জন্মগত ভাবে কোন একটি ছেলে বা মেয়ে মানসিক ভাবে নিজেকে যথাক্রমে মেয়ে বা ছেলে হিসেবে চিন্তা করে থাকে এবং সে থেকে অনেক সময় নিজ উদ্যোগে শারীরিক লিঙ্গ পরিবর্তন করে থাকে। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে শারীরিক লিঙ্গ পরিবর্তনের বিষয়টি মানসিক চিন্তার সাথে সাথে আপনা আপনি ঘটে না; এই শারীরিক পরিবর্তনটা করে নিতে হয় যেটা সামাজিক ভাবে গ্রহণযোগ্য নয় এবং হয়তো সমাজের জন্য নেতিবাচকও। অপর দিকে হিজড়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন শারীরিক অসঙ্গতি। কাদের মাহমুদ-এর শ্লীল-অশ্লীল অভিধান-এ Hermophrodite (হার্মোফ্রোডাইট)-কে উভয়লিঙ্গযুক্ত হিসেবে এবং হিজড়াকে লিঙ্গ-বিহীন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে এবং উল্লেখ করা হয়েছে “ভারতীয় উপমহাদেশে হিজড়া বলতে খোজা, উভয় লিঙ্গ, লিঙ্গবিহীন – এই তিন শ্রেণিকেই বুঝায়।”  দুঃখজনক ভাবে এ বিষয়টি শরীফার গল্প-তে সঠিক ভাবে তুলে ধরা হয়নি। বরং ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া নিয়ে একটা লেজেগোবরে করা হয়েছে।

জৈবিক লিঙ্গ পরিচয় ও সামাজিক লিঙ্গ পরিচয়ের অসঙ্গতির বিষয়টি যদি ব্যক্তির মানসিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে থাকে (যাকে খুব সম্ভবতঃ Gender Dysphoria নামে অভিহিত করা হয়) তবে সে ব্যক্তিকে নিয়ে ট্রল করা উঠতি তরুণ সমাজকে ঐ ব্যক্তি বা পরিবারের বিপর্যয় সম্পর্কে সচেতন করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি Transgender এর মানসিক/শারীরিক লিঙ্গ পরিবর্তন বিষয়ে সামাজিক নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করার উদ্যোগ নেয়াটা সমীচীন বলে মনে হয়। কিন্তু বিষয়টিকে প্রকাশ্যে আলোচনা বা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আমরা খুব একটা যত্নশীল হতে পারিনি। বিষয়টির ত্রুটিগুলো তুলে ধরে এর সংশোধনে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যায় তার সুপারিশ না করে প্রকাশ্যে পাঠ্য পুস্তক ছেঁড়াটা চিন্তাশীল ও আধুনিক জাতি গঠনে ভূমিকা রাখে বলে মনে হয় না। প্রকৃত জ্ঞান মানুষকে চিন্তাশীল ও তীক্ষ্ণ অনুধাবন শক্তিসম্পন্ন একজন ব্যক্তিতে পরিণত করে, বই ছেঁড়ার মতো ধ্বংসাত্মক কাজে প্ররোচনাদানকারী ব্যক্তিতে নয়। এতে তরুণ শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হতে পারেন।

সার্বিকভাবে হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডার যেটাই হোক না কেন গুরুত্ব (Importance) ও প্রাধিকার (Priority) বিবেচনা করে বিষয়টিকে পাঠ্য পুস্তকে স্থান দেয়া উচিত। আর সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এটা আদৌ ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দেয়ার মতো উপযুক্ত বিষয় কি না তা ভেবে দেখা উচিত। কেন না জ্ঞান গ্রহণের জন্য শিক্ষার্থী ও সমাজের মানসিক প্রস্তুতিও গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।

আশা করি বসন্তের ছোঁয়ায় আমাদের চিন্তার অসারতা দূরীভূত হবে নিমেষেই। সবাইকে বসন্তের শুভেচ্ছা।   

ব্যবস্থাপক |

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশন:১৯৯৯-২০০০

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০