fbpx

ট্রয় নগরীঃ আদ্যোপান্ত

ট্রয় নগরীর কথা শুনেননি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। গ্রিক মিথোলজিতে ট্রয় নগরীর ধ্বংসের কথা উল্লেখযোগ্য একটি স্থান দখল করে আছে। সাথে রয়েছে ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর নারীদের একজন হেলেন অব ট্রয়ের কারণে লেগে যাওয়া যুদ্ধের কথা। যেমন করে ইতিহাসের পাতায় রয়েছে হারিয়ে যাওয়া ‘সোনার শহর এল ডোরাডো’ কিংবা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাওয়া সভ্যতা ‘আটলান্টিস’- এর কথা, ঠিক তেমনি ইতিহাসের পাতায় লিখা রয়েছে একটি শহর ট্রয়ের কথা এবং ১০ বছরের ট্রোজান যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এটির ধ্বংস হবার কথা।

পাঠক, ট্রোজান যুদ্ধের নামটা কি একটু পরিচিত লাগছে? আপনারা হয়তো ট্রোজান হর্স বা ট্রোজান ভাইরাসের নাম শুনে থাকবেন। এই নামটি আসলে এসেছে ইতিহাসের এই ট্রয় নগরীর ট্রোজান যুদ্ধের থেকেই। ট্রোজান মানে হলো ‘প্রচীন ট্রয় নগর- সম্বন্ধীয় কিংবা প্রাচীন ট্রয় নগরবাসী।।’ ট্রোজান যুদ্ধে গ্রিকদের হাতে পরাজিত হয় ট্রয় নগরী। হেলেনের সৌন্দর্য, হেক্টর এবং অ্যাকিলিসদের বীরত্ব, গ্রিকদের ধূর্ততা, দেব- দেবী সবকিছু মিলিয়ে ট্রোজান যুদ্ধের গল্প অবিশ্বাস্য মনে হলেও প্রায় ৩ হাজার বছর পরেও মানুষকে কৌতূহলী করে তোলে। তবে এখনো প্রশ্ন থেকে যায়, ট্রয় নগরী কি আসলেই এ পৃথিবীতে ছিল? নাকি তা শুধুই একটি গ্রিক শ্রুতিগল্প?

প্রাচীন এশিয়া মাইনরে উত্তরে (বর্তমানে তুরস্কের আনাতোলিয়া রাজ্য) ছিল ট্রয় নামক এক নগরী।  ট্রয় একটি কিংবদন্তির শহর। এই শহর এবং সংশ্লিষ্ট যুদ্ধের বর্ণনা প্রাচীন গ্রিসের অনেক মহাকাব্যেই দেখা যায়, বিশেষত ইলিয়াড। হোমার রচিত অমর দুই মহাকাব্যের একটি এই ইলিয়াড। এই ঐতিহাসিক ট্রয় নগরীর রাজা ছিলেন প্রিয়াম এবং রাণী ছিলেন হেকবা। তাদের আদরের পুত্রের নাম ছিল প্যারিস। রাজপুত্র প্যারিসের কারণেই মূলত ট্রয়ের যুদ্ধটি শুরু হয়। রাজপুত্র প্যারিস, গ্রিসের স্পার্টা রাজ্যের রাজা মেনেলাস এর স্ত্রী হেলেন এর প্রেমে পড়ে যান। তারপর তিনি হেলেনকে নিয়ে ট্রয়ে পালিয়ে আসেন। এর ফলে শুরু হয় স্পার্টা আর ট্রয়ের মধ্যকার সেই যুদ্ধ!

ট্রয় যখন উন্নতির শিখরে, চারদিকে তখন গ্রিকদের রাজত্ব। স্বাভাবিকভাবেই গ্রিকরা ট্রয় দখল করার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং এখান থেকে হোমারের গল্পের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে ওঠে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম এক যুদ্ধের সঙ্গে। ইতিহাসে এই যুদ্ধ পরিচিত ট্রোজান যুদ্ধ নামে, যা স্থায়ী হয়েছিল দীর্ঘ দশ বছর।

হোমার তাঁর ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডেসি’ রচনা করেন বীর যোদ্ধা অ্যাকিলিস ও রাজা অ্যাগামেমনন এবং তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, ট্রোজান যুদ্ধ বাস্তব ঘটনা। হোমার এমন এক বংশ থেকে এসেছেন যারা গীতের মাধ্যমে ইতিহাস মনে রাখতেন। হোমার হয়তো তাদের একজন এবং তিনি তার গীতি গল্পকে প্রথম অক্ষরের মাধ্যমে তুলে ধরেন।

গল্পের শুরু হয় অ্যাকিলিসের পিতা মিরমিডোন্সএর রাজা পিলিয়াস এবং গ্রিক দেবী থেটিসের বিবাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। অনুষ্ঠানে সকল দেবতাকে নিমন্ত্রণ করা হলেও ‘ইরিস’, দ্বন্দ্বের দেবীকে নিমন্ত্রণ করা হয় না। ইরিস তবুও অনুষ্ঠানে আসেন। তিনি একটি সোনালি আপেল সঙ্গে আনেন, যাতে লেখা ছিল “সবথেকে সুন্দরীর জন্য”। তিন দেবী হেরা, এথিনা এবং এফ্রোডাইটি আপেলটি দাবী করেন এবং জিউসকে বিচারক হবার আহবান জানান। কিন্তু জিউস অসম্মতি জানান এবং ট্রয়ের সুদর্শন রাজকুমার প্যারিসকে এ দায়িত্ব দেন। প্যারিস এফ্রোডাইটিকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। এফ্রোডাইটি প্যারিসকে পৃথিবীর সুন্দরীতম রমণী দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। কিন্তু সবচেয়ে সুন্দরী রমণী হেলেন ছিলেন অ্যাগামেমননের ভাই স্পার্টার মেনালাউসের স্ত্রী।

প্যারিস বাণিজ্যিক কাজে স্পার্টা ভ্রমণে যান এবং সেখান থেকে হেলেনের সঙ্গে পালিয়ে ট্রয়ে ফিরে আসেন৷ মেনালাউস তার স্ত্রী এবং গ্রিকদের সম্মান ফিরিয়ে আনতে তার ভাই মাইসিনির অ্যাগামেমননের সাহায্য প্রার্থনা করেন। অ্যাগামেমনন সহজে রাজী হয়ে যান, কেননা এর মাধ্যমে ট্রয়কে গ্রিক সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে জয় করার সম্ভাবনা ছিল।

অ্যাগামেমনন অন্যান্য গ্রিক রাজাদের একত্রিত করেন এবং প্রায় এক হাজার জাহাজ নিয়ে ট্রয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হন। গ্রিকদের যাত্রাপথে বাধা হন দেবতা আর্টেমিস। সমুদ্রের বাতাস থেমে যায় আর্টেমিসের অভিশাপে। দেবতাকে খুশি করতে অ্যাগামেমনন তার নিজ কন্যা ইফিজিনিয়াকে হত্যা করেন উৎসর্গ হিসেবে। কেউ কেউ বলেন, ইফিজিনিয়ার সঙ্গে অ্যাকিলিসের বিয়ে হবার কথা ছিল। আর্টেমিস এতে তার অভিশাপ তুলে নেন এবং গ্রিক সৈন্যবাহিনী অ্যাগামেমননের নেতৃত্বে ট্রয়ে পৌঁছায়।

কিন্তু দীর্ঘ দশ বছরে তারা ট্রয়ের দেয়াল ভেদ করতে পারেনি। যুদ্ধের শেষ বছরে অ্যাগামেমনন এবং তৎকালীন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা অ্যাকিলিসের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর ফলে অ্যাকিলিস যুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। এ সময় প্যাট্রোক্লাস অ্যাকিলিসের বর্ম পরে যুদ্ধে যান এবং হেক্টরের হাতে নিহত হন। প্যাট্রোক্লাস অ্যাকিলিসের নিকট গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। হোমার ইলিয়াডে তাদের ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক তুলে ধরলেও প্লেটো এবং অন্যরা তাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক তুলে ধরেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে অ্যাকিলিস হেক্টরের সাথে যুদ্ধের আহবান জানান এবং হেক্টর পরাজিত হন। অ্যাকিলিস হেক্টরের মৃত দেহ টেনে তাদের শিবিরে নিয়ে আসেন। তৎকালীন ট্রয়ের রাজা এবং হেক্টরের পিতা প্রিয়াম রাতের অন্ধকারে অ্যাকিলিসের সাথে একা সাক্ষাৎ করেন এবং তার সন্তানের দেহ ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানান। অ্যাকিলিস রাজি হন এবং ১১ দিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন।

0505 2

এর মধ্যে ওডেসিয়াস একটি কাঠের ঘোড়া তৈরির বুদ্ধি বের করেন। একটি বিরাট কাঠের ঘোড়া, যার ভেতরে গ্রিক সৈন্যরা অবস্থান নেন। ঘোড়াটি তীরে রেখে গ্রিকরা ফিরে যায়। ট্রোজানরা ভাবে ঘোড়াটি তাদের জন্য উপহার হিসেবে রেখে গিয়েছে গ্রিকরা। ট্রোজান সৈন্যরা তাদের দেয়াল ভেঙ্গে ঘোড়াটিকে শহরে নিয়ে যায়। রাতে যখন তারা তাদের বিজয় উদযাপনে মত্ত থাকে তখন ঘোড়ার ভেতর থেকে গ্রিক সৈন্যরা বের হয়ে আসে এবং শহরের ফটক খুলে দেয় অন্যান্য গ্রিক সৈন্যদের প্রবেশের জন্য, যারা আসলে ফিরে না গিয়ে সমুদ্রে অপেক্ষারত ছিল। এভাবে তারা জয় করে ট্রয় নগরী। প্রিয়ামকে হত্যা করা হয়। হেক্টরের শিশু সন্তানকে ট্রয়ের দেয়াল থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলা হয়। অ্যাকিলিস নিহত হন প্যারিসের ছোড়া তীরে। এভাবে শেষ হয় দীর্ঘ দশ বছরের ট্রোজান যুদ্ধ।

যুদ্ধ শেষে গ্রিকদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন খুব একটা সহজ হয় না। দশ বছর সমুদ্রে ঘুরে হেলেনকে নিয়ে নিজ দেশে ফেরেন মেনালাউস। মেনালাউস হেলেনকে হত্যা করতে চাইলেও তার সৌন্দর্যের কাছে পরাজিত হন। অ্যাগামেমনন নিজ দেশে ফিরে প্রথম রাতেই নিহত হন তার স্ত্রীর প্রেমিকের দ্বারা।

হোমারের বর্ণিত এই গল্পের সত্যতা বর্তমান পৃথিবী জানে না। বর্তমানে ট্রয় একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের নাম। হোমারের ইলিয়াডে যে ট্রয়ের উল্লেখ রয়েছে সেটিকেই এখন ট্রয় নামে আখ্যায়িত করা হয়। এর অবস্থান আনাতোলিয়া অঞ্চলের হিসারলিক নামক স্থানে। ট্রয়ের তুর্কী নাম ত্রুভা। অর্থাৎ, আধুনিক হিসারলিক-ই সেই প্রাচীন ট্রয় নগরী। এর ভৌগোলিক অবস্থান তুরস্কের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কানাক্কাল প্রদেশের সমুদ্র সৈকতের নিকটে এবং আইডা পর্বতের নিচে দার্দানেলিসের দক্ষিণ পশ্চিমে।

রোমান সম্রাট অগাস্টাসের রাজত্বকালে প্রাচীন ট্রয় নগরীর ধ্বংসস্তুপের উপর ইলিয়াম নামে নতুন একটি শহর নির্মিত হয়। কনস্টান্টিনোপল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইলিয়াম বিকশিত হয়েছে, কিন্তু বাইজান্টাইন রাজত্বের সময় ধীরে ধীরে এর পতন হতে থাকে। ১৮৬৫ সালে ফ্রানক কার্লভার্ট ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ সর্বপ্রথম ট্রয় নগরীর সন্ধান পান। তিনি হিসার্লিকে এক কৃষকের কাছ থেকে এক খন্ড জমি কিনে খনন কাজ শুরু করেন। কিন্তু তা সমাপ্ত করতে পারেন নি।

১৮৭০ সালে জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ হাইনরিশ শ্লিমান এই এলাকায় খনন কাজ শুরু করেন। এই খনন চলতে থাকায় এক সময় প্রমাণিত হয় যে, এখানে একের পর এক বেশ কয়েকটি শহর নির্মিত হয়েছিল। সম্ভবত এই শহরগুলোরই একটি হোমারের ট্রয়। অবশ্য এ নিয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু এটা প্রায় নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, হিত্তীয় রচনায় উল্লেখিত উইলুসা শহরটি এখানেই অবস্থিত ছিল। অনেকে মনে করেন ইলিয়ন এই উইলুসা নামেরই গ্রিক সংস্করণ।

ট্রয় নগরী হোক বাস্তবিক অথবা কাল্পনিক, এভাবেই কালের গর্ভে হারিয়ে যায় এরকম অনেক দেশ, রাজ্য, রাজা, নগরী। একসময় ইতিহাসের পাতা থেকেও হারিয়ে যায় এসব কথন। বলা যায় তখন ইতিহাসের মৃত্যু হয়।

১৯৯৮ সালে ট্রয় নামক এই প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় যুক্ত করা হয়। হোক কাল্পনিক অথবা বাস্তব ট্রয় নগরীর ধ্বংস আমাদেরকে অনেক কিছু শেখায়- কোন জিনিস অর্জন নয়, অর্জনের পর রক্ষা করতে জানতে হয়, তা না হলে ট্রয়ের মতই একদিন ইতিহাসের পাতাও ধোঁয়াসা সৃষ্টি করবে।

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষাবর্ষঃ ২০১৯-২০

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়