fbpx

কল্পনার বসতি

…ভাবনার অনেকটা জুড়ে আরেকটা ‘ঘর’ গড়ে উঠেছে। সেটা এত আলিশান না— টিনের ঘর। নতুন না, আধা পুরনো টিনের তৈরি। নতুন টিনের বিলাসিতা পেলে আমার নান্দনিক ভাবনাতে যথেষ্ট আভিজাত্যহীনতায় আমার আশার পসরায় সুর-তালে ঝংকার উঠবে না। পুরনো পালঙ্ক জোগাড় করব একটা; মাথা ও পায়ের দিকে গোল গোল রেলিং থাকবে, খয়েরী রঙের সাদাসিধে কারুকাজের মাঝে নাকে ভেসে আসবে ‘ঘরুয়া গন্ধ’। মন খারাপের সময়গুলোতে সে ঘরের বাসিন্দা হব। দক্ষিণ দিকে জানালা থাকবে। আম, কড়ই, জাম, মেহগনি ইত্যাদি সবগাছ পাড়ি দিয়ে দক্ষিণা বাতাস আসবে। এই বাতাসের ঐশ্বর্য, শানশওকত, প্রতাপ ও গরিমাই থাকবে অনন্য মাত্রার। গায়ে লাগতেই খান্দানী অনুভূতি আসবে।

ঘরের পাশে আম-জামগাছের একটা ছোট্ট চারণভূমি থাকবে। জামগাছের কাঁচা জাম বাতাসে টিনের চালে ঝরে পড়বে। সেই টুপটাপ শব্দে আমার গাঢ় হয়ে আসা ভাতঘুম হয়ত ভেঙ্গে যাবে কোনো এক বিকেলে! গোশালিকেরা এসে আধখাওয়া পাঁকা জাম ফেলবে, বাচ্চাকাচ্চারা এসব কুড়িয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতা চালাবে; সবুজ গাছ, কালো-বেগুনি জাম, রঙিন শিশু সাথে দক্ষিণা বাতাস— কি সুন্দর দৃশ্য, আমার স্বর্গে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কয়েকগুন বাড়িয়ে দেবে! নেবু আর ওড়বড়ই গাছও থাকবে সেখানে। একটা কাঁঠাল গাছ থাকতে পারে— তবে কাঁঠাল আসবে না নিশ্চিত! পেয়ারা গাছও থাকবে। কাঁঠালতলায় একটা খোঁআড়ে কিছু হাঁস পালার ব্যবস্থা রাখব। সকাল সন্ধ্যায় একটু প্যাঁকপ্যাঁক না শুনলে কেমন যেন আড়ষ্টতা কাটবে না।

আমার বাড়ির পশ্চিম দিকটায় দেয়াল থাকবে না। বাড়ির পাশেই নদী আছে। গোধুলিতে ঘরের সামনে চাতালে বসে সেই নদীতে রোজকার সূর্যাস্ত দেখব। সূর্যাস্ত কিন্তু ভারী বেদনার ও এক শোকাতুর আবহে রঞ্জিত একটা ব্যাপার। সারাদিনে জগতের সবার সাথে ব্যস্ত সময় কাটায়ে সূর্য্যিমামা বিদায় নেয়। বিদায়বেলায় গাছগাছালিরা ঠাই, নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে— নিরবে কান্না করে; ঝিঁঝি পোকা, যমকুলিরা সরব কান্নায় মেতে উঠে। শিশিরের কান্নায় ঘাস ভিজে একাকার হয়ে যায়। মেঘেরা জমাট বেধে বিদায় দিতে আসে। সবাই বিরহে কাতর, কালো, অন্ধকার হয়ে থাকে। দিনমণি সবাইকে রাঙ্গিয়ে তোলার চেষ্টা করে কিন্তু গায়ে বল আসে না। বুড়িয়ে যাওয়া দিবাকর বিরহাতুর মেঘেদের ঈষৎ রক্তিম আভা বৈ আর কি-ই বা দিতে পারে? এবং এই চেষ্টার ফল আকাশের মেঘ ছাপিয়ে পৃথিবীতে আর প্রবেশ করতে পারে না। পরাস্ত হয়ে আপনাকেই হারাতে হয়। পরিবেশে কি ভয়ানক আর্তনাদের সুর বাজে! এই সুর শুধু নিঃসঙ্গ আর একাকীত্বের অন্তর্মুখী মানুষগুলো শুনতে পারে।

সন্ধ্যা হলে হারিকেন জ্বালাব। এখন দেখছি বাজারের বিদ্যুতের হারিকেন পাওয়া যায়, না না মশাই— ওগুলো না। কেরোসিনের হারিকেন। নিজ হাতে চিমনি ধুয়ে-মুছে সলতেতে আগুন চড়াব। দরকারে-অদরকারে, প্রয়োজন কিংবা অপ্রয়োজনে হারিকেনের রেগুলেটর স্ক্রু টিপে আলোর পরিমাণ কমবেশি করব। সলতে উঠানামা করার সময় খাঁজকাটা স্ক্রুর চাপে ক্র‍্যাক ক্র‍্যাক শব্দ হবে— কি উৎকৃষ্ট সে আওয়াজ! পৃথিবী বিক্রি করে দিলেও কোন শিল্পী এমন সঙ্গীতের আয়োজন করতে পারবে না। হারিকেনের আলোয় আত্মবিসর্জন দিতে চাওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিশাচর পতঙ্গেরা চিমনিতে ধাক্কা খেয়ে অজ্ঞান হয়ে হয়ে পড়বে। আমি তখন কমলাকান্তের দপ্তর খুলে ‘পতঙ্গ’ অধ্যায়ের প্র‍্যাক্টিকেল ক্লাস করব। উনিশ-বিশ শতকের বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতি, নজরুল ও শরৎচন্দ্রেরা ঠাঁই পাবে সে ঘরের দাদার কালের প্রায় খসে পড়া শেলফের তাকে তাকে। হারিকেনের আলোয় আমি সে বইগুলোই বের করে করে পড়ব।

প্রত্যেকটা পূর্নিমার রাতে চাঁদকে ভুলিয়ে নেওয়ার জন্য শিস দেওয়ার কমতি রাখব না। ক্লান্ত হয়ে গেলে ক্যাসেট প্লেয়ারে গান ছেড়ে দেব— ওওও চাঁদ, সামলে রাখো জোছনাকে! ও হ্যা, সেই ঘরে একটা অডিও ক্যাসেট প্লেয়ারও থাকবে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, কিশোর কুমার, শ্রীকান্ত, নাচিকেতা হয়ে রুনা লায়লা সহ আরো অনেকের অনেকগুলো ক্যাসেট সংগ্রহ করে নেব। পুর্নিমা যখন এই জগত সংসারে জোছনার সাগর বসিয়ে দেবে তখন আমি সুরের মূর্ছনায় সেখানে ভেসে বেড়াব।

কোনোদিন সকালে হয়ত টিনের চালে ঝুম বৃষ্টির তালে ঘুম ভাঙবে। চোখ মেলেই জানালা দিয়ে শিমপাতার গোসল করা দেখব। চাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টি ধারার উদ্দাম নৃত্যের জেল্লা দেখে বিষ্ময়ে আমি বেহুশ হয়ে পড়ব। বৃষ্টিতে ঘরের ভেজা মেঝের পরশ পায়ে মাখাব— বিছানার উষ্ণতায় শুষ্ক হয়ে যাওয়া পা মাটির সংসর্গে শীতল হয়ে উঠবে। বৃষ্টি থেমে গেলে ভেজা মাটির গন্ধ নেব— সে মাটির কি সুভাস, কি কৃষ্ণতা, কি মায়া, কি শীতলতা!

ঘরের এক কোণে পাটের শিকায় একটা হুক্কা বাঁধা থাকবে। বেহুদাই পথচারীদের ডেকে এনে ঘরে জলসা বসাব। তাদের বেতের মোড়ায় বসতে দেব। নানান পায়চারি হবে। পান নাই বলে মিছে দুঃখের অভিনয় করে হুক্কা সাধব। তারাও তামাকের লোভ সামলাতে পারবে না। হুঁকার কলকেতে তামাকের মাঝে টিকায় আগুন চড়িয়ে গড়ৎ গড়ৎ আওয়াজের ফাঁকে দৈনন্দিন জীবনের নানান কথা-আকথা শোনাতে সত্য মিথ্যের জাল বুনবে। আমি এই অভিনয় কিংবা সবিনয় বর্ণনা দুটোই উপভোগ করব। ভালো কথা— তখন হুকা টানা কিংবা তামুক খাওয়ার মানুষ থাকবে তো?

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়