fbpx

বিড়াল

(বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিড়াল প্রবন্ধ থেকে কাব্যে রূপান্তর)

আমি শয়নগৃহে বসিয়া চারপায়ীতে
ঝিমাইতেছিলাম ধরিয়া হুকা হাতে
ক্ষুদ্র আলো মিটমিট করিয়া জ্বলে
প্রেতবৎ নাচিতেছে, ছায়া পড়ে দেয়ালে
আহার আসিতে আরো হইবে দেরি,
মনে মনে ওয়াটারলুর যুদ্ধ আসি ঘুরি
ভাবিতেছি যদি হইতাম নেপোনলিয়ন—
পারিতাম কি জিতিতে ওয়াটারলুর মহারণ?
এমত সময় হইল একটি ক্ষুদ্র শব্দ ’মেও’
ভ্রম হইল, ওয়েলিংটন বলে ’আফিং দেও’
প্রথম উদ্যমে, মনে ভাবিলাম বলিব কিছু কথা
‘ডিউক, দিয়েছি পুরস্কার সকল মানিয়া সব প্রথা’
লোভ সামলাও, আফিং আর পাবেনা অদ্য
সুখী হইয়ো তাতেই জিতিয়াছো যে যুদ্ধ
ডিউক বলিল ’মেও’
বুঝিলাম ইহা মার্জার বৈ নহে আর কেও।
প্রসন্ন আমার জন্য রাখিয়াছিল যে দুগ্ধ
নিঃশেষ করিয়া তাহা উদরে করিয়াছে রুদ্ধ
আমি যখন যুদ্ধের মাঠে ব্যস্ত ব্যূহ রচনায়
সাবাড় করিয়াছে তখন, অত দেখি নাই!
নির্জাল দুগ্ধপানে হইয়া পরিতৃপ্ত
আপন মনের সুখ করিতেছে প্রকটিত
মেও মেও করে- বুঝিলাম করিতেছে ব্যঙ্গ
ভাবখানা এই , ‘তোমার দুধতো করিয়াছি সাঙ্গ’
মার্জার বুঝি মনে মনে ভাবিতেছিল এই
’কেহ মরে বিল ছেঁচে, কেহ খাই কই’
আমি কি করিব, করিতে পারিলাম না ঠিক
দুগ্ধ আমার বাপের নহে, যে পারে লুন্ঠিক!
দুধ মঙ্গলার, দুহিয়াছে প্রসন্ন
অধিকারে বিড়াল-আমার, উভয়েরই অন্ন
সুতরাং রাগ আর করিতে নাহি পারি
তবে প্রথার পালন অতীব দরকারি
’বিড়াল যদি করিল দুগ্ধ পান
তবে সুপুরুষ, তাহারে লাঠি ঠ্যাঙাইতে যান’
হেন প্রথা লঙ্ঘিতে হইব কুলাঙ্গার মনুষ্যকুলে,
পাছে ’কাপুরুষ’ বলে বিড়াল- স্বজাতি-মণ্ডলে।
অতএব পুরুষের ন্যায় আচরনই হইবে করিতে
নামাইলাম হুকা হস্ত হইতে সকাতরচিত্তে
বহু সন্ধানে আবিষ্কার করিলাম এক ভগ্ন যষ্টি
ঠ্যাঙাইব আজ মার্জারের চৌদ্দগোষ্ঠী
আমারে চিনিত মার্জারী, যষ্টিতে ভীত নহে
একটু সরিল কেবল, বসিল মুখপানে চাহে
বলিল, ’মেও!’ কত ভাব জুড়িল তারি সাথে
যষ্টি ত্যাগে, হুকা লইয়ে আসিলাম শয্যাতে
প্রাপ্ত হইলাম দিব্যকর্ণ, বুঝিলাম সব কথা
একে একে বিড়াল বলিতেছে মর্মের যত ব্যথা
বিড়াল কহিলো, ’মারপিট কেন হে কমলা?
ভাবিয়া দেখ কে খায় আহার সমস্ত একলা?
ক্ষীর, সর, দুগ্ধ, দধি, মৎস্য, মাংস সকল;
তোমরা মনুষ্যই করিয়াছ তার ষোলকলা দখল।
মার্জারী বলে, প্রভেদ কি, মনুষ্য আর বিড়ালে?
ক্ষুধা-তৃষা লিখিয়াছে প্রভু আমাদেরও কপালে।
তোমরা খাও, আপত্তি করিলাম কোন কালে?
আমরা খাইলেই ঠ্যাঙাইতে কোন শাস্ত্র বলে?
মনুষ্য, আমার কাছে কিছু উপদেশ কর গ্রহন,
বিজ্ঞ চতুষ্পদের শিক্ষা বিহনে নহে জ্ঞানোন্নয়ন।
দেখ, শয্যাশায়ী মনুষ্য! জানতো কি ধর্ম?
পরোপকার-ই যদি হয় তাহার প্রধান কর্ম
শোন, আহিরিয়া তোমার দুগ্ধ
আমার তরে পরোপকার হইলো সিদ্ধ।
তুমি তাই পরম ধর্মের ফলভাগী
চুরি আর যাহাই করিলাম- আমি অভাগী।
আমি তোমার ধর্মসঞ্চয়ের মূলীভূত কারণ,
প্রহার ছাড়িয়া প্রশংসায় আমারে করো বরণ।
দেখ, আমি চোর হইয়াছি কি সাধে?
খাইতে পাইলে চোর হয় কোন নির্বোধে?
বড় যে সাধু, চোরের নামে রাগিয়া হই খুন-
তাহারা চোর অপেক্ষা অধার্মিক শতগুন!
চুরি নাহি করে তাহারা, নহে প্রয়োজন
তবুও চোরের প্রতি বিমূখ, থাকিতে এত ধন!
অধর্ম চোরের নহে-চোরে যে চুরি করে,
সে অধর্ম্ম গিয়ে পড়ে কৃপণ ধনীর ঘাড়ে।
চোর যদি দোষী বটে চুরির কারনে,
কৃপণ ধনী তদাপেক্ষাও দোষী শতগুনে।
চোরের দণ্ড হয়; চুরির মূলে যে জন-
কৃপণ সে ধনী, তাহার দণ্ড হইবে কখন?
দেখ, প্রাচীরে প্রাচীরে করি মেও মেও,
তবু মাছের কাটাখানা ডাকিয়া দেয় না কেও।
মাছের কাটা, পাতের ভাত নর্দমায় দেয় ফেলে,
উপবাসী আমি ঘুরি পথে, ক্ষুধায় জঠর জ্বলে।
তোমরা মনুষ্য, রাখ সদা পেট ভরে;
আমার পেটের ক্ষুধা জানিবে কি প্রকারে?
দরিদ্রের তরে ব্যথিত হইলে নিন্দার কি আছে?
হ্যা, আমার তরে ব্যথিত হওয়া- তাহা মিছে!
যে কভু অন্ধকে তাড়ায়, না দেই মুষ্টিখানি দান-
সেও পড়ে রাজা ফাঁপরে বিনিদ্র রজনী কাটান।
পরের ব্যথায় ব্যথিত হইতে সকলেই আছে রাজি
তবে ছোটলোকের দুঃখে কাতর হওয়া, ছি! ছি!
যদি অমুক ন্যায়ালঙ্কার কিংবা শিরোমণি-
আসিয়া খাইয়া যাইত তোমার দুধখানি;
তবে তুমি তাহারে মারিতে ঠেঙ্গা লইয়া?
করজোড়ে চাহিতে আরেকটু দিতে আনিয়া!
আমার বেলায় লাঠি কেন হে কমলাকান্ত?
ন্যায়ালঙ্কার তুমি কেন করিতেছ প্রভেদ দৃষ্টান্ত?
তুমি বলিবে তাহারা অতি পণ্ডিত, বড় মান্যলোক;
তাহাদের ক্ষুধা আমার অপেক্ষা বেশি কতটুক?
তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্যজাতির রোগ,
দরিদ্রের ক্ষুধা আপনারেই করিতে লাগে ভোগ!
খাইতে বলিলে যে দেখায় বিরক্তির ভাব,
তাহার তরে ভোজের আয়োজনে নেই অভাব!
ক্ষুধার জ্বালায় যে খায় বিনা আহ্বানে,
চোর বলিয়া দণ্ড করো সেই জনে।
দেখ, আমাদিগের দশা কে দেখে?
মেও মেও করি তব প্রাচীর, প্রাঙ্গণ, গৃহে।
যদি কেহ হইল তোমাদিগের সোহাগের বিড়াল,
নানান পদ পায় সে, লভে নানা শাখা-ডাল।
কেহ হয় বৃদ্ধের যুবতি ভার্য্যার সহোদর;
কেহ হয় মূর্খ ধনীর সতরঞ্চের জাদুকর!
তবেই তাহার পুষ্টি, সুখী হয়ও পরম,
তাহার লেজ ফুলে, গায়ে তার হয় পশম।
দেখিয়া তাহাদের রূপের ছটার ছবি,
কত মার্জার পথেঘাটে হইয়া গেল কবি!
আর আমাদিগের দেখ কি দশা!
অনাহারে উদর কৃশ, অভুক্ত জাগি মহানিশা।
লাঙ্গুল বিনত, পাইনা শক্তি একরত্তি,
দাঁত বিচ্যুত, নিম্নগামী জিহ্বার গতি!
অস্থি পরিদৃশ্যমান, চাই তো যাবে গোনা,
ডাকিতেছি মেও মেও, খাইতে পাই না।
ঘৃণা নাহি করো, কালো চামড়া মূলে-
অধিকার আছে কিছু মৎস মাংস সকলে।
আমাদের খাইতে দাও- নহিলে করিব চুরি;
এ পৃথিবীতে কি হেতু অনাহারে ঘুরিফিরি?
কৃষ্ণবর্ণ, শুষ্কমূখ আর করুন মেও মেও ডাকে-
আমাদের তরে দুঃখ পায় না তোমাকে?
চোরের দণ্ড আছে সর্বজন জানে।
নির্দয়তার দণ্ড নাই কি কারনে?
দরিদ্রের আহার সংগ্রহে কর দণ্ড-
ধনীর কি করিবে যে কৃপণ প্রচণ্ড?
তুমি কমলা, দূরদর্শী, যেহেতু আফিংখোর-
বল, ধনীর দোষেই দরিদ্র হয় না চোর?
কেন, পাঁচশত দরিদ্রকে করিয়া বঞ্চিত-
একজন লইবে সংগ্রহে আহার্য আছে যত?
লইল যদি, উদ্বৃত্ত যাহা বাহিয়া পড়ে-
দিবে না কেন তাহা দরিদ্রের তরে?
যদি না দেয়, দরিদ্র চুরি করিবে অবশ্য,
অনাহারে মরিয়া যাওয়া কারো নহে উদ্দেশ্য।
আমি আর সহ্য করিতে না পেরে-
’থাম! থাম মার্জারপণ্ডিত’, বলিলাম ঝেড়ে।
তোমার কথাগুলো ভারি সোশিয়ালিষ্টিক!
শুনিলে তাহা- বিশৃঙ্খলা বাধিবে দিকেদিক।
যদি কেহ ক্ষমতার মাপ অনুসারে-
চোর ভয়ে ধনসঞ্চয় করিতে না পারে,
তবে কেহ ধনসঞ্চয়ে নাহি দিবে মন
তাহাতে কি করে সমাজের বাড়িবে ধন?
মার্জার বলিল, ’না বাড়িল তো আমার কি?’
সমাজের ধনবৃদ্ধিতে ধনীর ধন বাড়ে দেখি।
ধনির ধনবৃদ্ধি যদি নাহি হইল তবে-
দরিদ্রের তাহাতে কি আসে বা যাবে?
আমি বলিলাম, ধনীর ধন যদি নাহি বাড়ে।
পণ্ডিত, সমাজে উন্নতি হইবে কি প্রকারে?
বলিলাম আরো কথা কিছু যুক্তি-শাস্ত্র যোগে;
যুক্তি-শাস্ত্রের ধার না ধেরে বিড়াল গেল রেগে।
’আমি যদি মরিলাম অভুক্ত-অনাহারে,
সমাজের উন্নতি কিছু আসিবে উপকারে?’
বিড়ালকে বুঝান আমার হইল দায়-
সে বড় নৈয়ায়িক, বুঝানোর উপায় নাই।
এ মার্জার সুবিচারক, সুতার্কিকও বটে-
সুতরাং না বুঝিবার দাবি করিল অকপটে।
আমিও আর রাগ না করিতে পারি-
বলিলাম কথা কিছু সমাজের উপকারী।
’শোন মার্জার-
সমাজের উন্নতিতে ধনীর বড় দরকার।
দরিদ্র কি করিবে, কি আছে তার ধন?
তবেই সমাজের তরে দরকার চোরের দণ্ডণ
মার্জারী কহে রহিয়া কিছুকাল মৌনভাবে
’চোরকে ফাঁসি দাও, আপত্তি নাহি রবে
তবে আর একটি নিয়ম কর তারি সাথে-
মানিয়া লইব সাজা সব মাথা পেতে।
নীতিবান যে বিচারক চোরকে সাজা দিবে
আগে সে তিন দিবস উপবাস করিবে।
অনাহারে যদি সে না করিল চুরি
তবে সানন্দে আমায় দিও ফাঁসির দড়ি
হে কমলা, লইয়াছিলে যষ্টি- করিতে প্রহার
তুমিও তিন দিবস করিবে না আহার।
যদি তোমায় ইতিমধ্যে নসীবাবুর ভাণ্ডারে,
চোর হিসেবে কেহ যদি নাহি ধরে-
তবে লাঠি হাতে ঠেঙ্গাইয়া মারিও আমারে।


বিজ্ঞ লোকের মতে বিচার যখন শেষ
পরাস্ত হইবার পূর্বে কিছু দিও উপদেশ।
আমি সেই প্রথানুসারে-
বলিলাম জ্ঞানময় কিছু কথা মার্জারে;
’শোন, এ সকল অতি নীতিবিরুদ্ধ প্রলাপ,
ইহার আন্দোলনেও রহিয়াছে পাপ।
ছাড় হে এ দুশ্চিন্তা আর বিলাপধ্বনি,
মার্জার, ধর্মাচরণে মন দাও একটুখানি।
যদি তুমি চাহ, তবে পাঠার্থে-
নিউমান ও পার্কারের গ্রন্থ পারি দিতে।
কমলাকান্তের দপ্তরও আছে সংগ্রহে আমার
যদি পার পড়িতে তবে কিছু হইবে উপকার।
কিছু হউক আর নাই হউক,পড়িয়া কমলানামা
বুঝিতে পারিবে আছে আফিঙ্গের অসীম মহীমা
এক্ষণে স্বস্থানে যাও, ছাড়ো এ আঙ্গিনা
প্রসন্ন বলিয়াছে কাল দিবে কিছু ছানা;
ভাগ দিব- জলযোগের কালে আসিও এ বাড়ি;
চতুষ্পদী, অদ্য আর কাহারও খাইও না হাঁড়ি।
ক্ষুধায় যদি নিতান্ত হও অধীর, অঘোর;
তবে আসিও- আফিঙ্গ পাইবে সরিষাভোর।’
মার্জার বলিল,’আফিঙ্গের নাই প্রয়োজন
ক্ষুধানুসারে বিবেচনা হইবে হাঁড়ি-ভোজন।’
বিদায় হইল বিড়াল—
পতিত আত্মায় ধরিয়েছে আলোর মশাল!

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়