fbpx

অক্টোবর ১৬, ২০২৪

নবান্ন-বুড়ির ইতিকথা

‘বুড়িপুড়ানো দিয়ে শেষ, ধান কাটা আর নবান্ন দিয়ে শুরু’- কার্তিক আর অগ্রহায়ণের হাতে হাত ধরে প্রস্থান আর আগমনের এই আঞ্চলিকতার চল দেখে এসেছি ছোট থেকেই। বাংলা ঋতুর পালাবদলে কার্তিকের পরেই আসে অগ্রহায়ণ। বর্ষার রেখে যাওয়া জংলা পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন করতেই হয়তো “বুড়িপুড়ানো” উৎসবের চল উঠেছিলো এই জনপদে। কলাগাছ, সুপারি গাছের শুকনো পাতা, ধানের শুকনো খড়, খেঁজুর গাছের শুকনো পাতা দিয়ে এই বুড়ির ঘর বানানো হতো। তারপর একটা লম্বা বাঁশ মাটিতে সোজা করে পুঁতে সেটাকে অবলম্বন করে ঐ শুকনো খড় পাতা ঘিরে দিয়ে বুড়ির ঘর বানানো হতো। সন্ধ্যার শিশির যখন পড়তে শুরু করতো তখন হৈ-হুল্লোড় করতে করতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হতো বুড়িরঘর। ছোট বাচ্চারা অসীম বিস্ময় আর কৌতূহলী চোখে এই উৎসবে সামিল হতো অগ্রজদের সাথেই। আগুনের ফুলকি গুলো যতক্ষণ উর্ধ্বাকাশে উড়তে থাকতো আনন্দের আঁচ টুকু ততোক্ষণই সংক্রমিত করতো উপস্থিত সবাইকে। এই পর্ব শেষ হলে উপস্থিত দর্শকদের মিষ্টি জাতীয় খাবার দিয়ে বিদায় জানানোর চল ছিল। সম্ভবত বুড়ির ঘরকে শীর্ণ জীর্ণ পরিবেশের রূপকের আদলে চিত্রায়িত করাটাই এই লোকাচারের অন্তর্নিহিত দৃষ্টি। মানবচিত্ত তার জীর্ণতার খোলসের আবরণ ভেদ করতে পারুক আর নাই পারুক, বের হবার জন্য যে মানব মনের চরম আকুতি সেটা বিভিন্ন লৌকিক আচারে ঠিকই প্রকাশ পায়। 

বুড়ির ঘর পোড়া গন্ধ হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার আগেই উদীয়মান সূর্য জানান দিতো ধানকাটা উৎসবের। দক্ষিনবঙ্গে তখনো আবাদি জমিতে চিংড়ি ঘেরের জোয়ার বইতে পুরোদমে শুরু হয়নি। তাই ধান জন্মানোর ফুরসত পেতো! অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে ধান কাটার মতো না হলেও লৌকিক আচারের প্রবর্তনায় পর্দা উঠতো ধানকাটার মৌসুমের। একগুচ্ছ ধানের শীষ কেটে এনে প্রথমে উঠানে লেপাপোঁছা জায়গায় রেখে সম্মান জানানোর প্রচলন ছিল ভাল ফসলের আশায়। এই রেশের হাত ধরাধরি করেই নামতো নবান্ন। ‘নবান্ন’ বলতে ডিজিটাল প্রজন্ম পিঠাপুলির একটা উৎসবের নাম জানলেও আদতে নবান্ন স্বয়ং নিজেই যে একপ্রকার রসনাবিলাসের মাধ্যম, সেটা সম্ভবত তাদের অজানাই রয়ে গেছে বাহারি দেশী-বিদেশী খাবারের আধিক্যতায়। নতুন চালের গুড়া, নতুন খেজুর গুড়, ডাবের জল আর শাসের মিশ্রণে যে এক প্রকার পানীয় তৈরী হতো সেটাকেই নবান্ন বলে চিনে এসেছি। লৌকিক আচারের এখানেও বিশ্রাম নেই! প্রথমে এই তৈরি করা পানীয় সৃষ্টিকর্তাকে প্রসাদ হিসেবে নিবেদন করা হতো পাশাপাশি পক্ষীকূলের উদ্দেশ্যে গাছের ডালে কিংবা উঁচু জায়গায় রেখে আসা হতো। প্রতিটা লোকাচারের পদযাত্রাই ঘটে অভীষ্ট মঙ্গলের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। ফসলি ধানের অনিষ্ট রোধে সম্ভবত পক্ষীকূলকে সন্তুষ্ট রাখবার এই প্রচেষ্টা। যদিও ইঁদুর এই বিবেচনায় প্রাধিকার লাভ করবার কথা! কে জানে? হয়তো নবান্নে ইঁদুরের অরুচি থেকে থাকবে!

jagannath pal
প্রাক্তন শিক্ষার্থী | সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, চুয়েট