fbpx

উইশবুক

সৌরভ দিনের বেলায় খুব একটা ভ্রমণ পছন্দ করে না। তাই বেশিরভাগ সময় রাত্রিতে ভ্রমণ করে। সিলেটের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখার জন্য ঢাকা থেকে রওনা দিল রাতের ট্রেনে।

ও একা একা ভ্রমণ করতে পছন্দ করে। একা ভ্রমণ করার মাঝে একটা অন্যরকম অনুভূতি লুকায়িত আছে। মুখোশধারী বন্ধুমহলের সংস্পর্শে থাকার চেয়ে একা থাকাই শ্রেয় নয় কি? আচ্ছা, আপনি একা একা কখনো ঘুরতে গেছেন? যদি না ঘুরেন তবে অন্ততপক্ষে একবারের জন্য হলেও ভ্রমণ করবেন। দেখবেন আপনি এক অন্য আপনিকে খুঁজে পেয়েছেন। নতুন করে ভালোবাসতে শুরু করবেন নিজেকে। কোনো এক অজানা স্নিগ্ধতা আপনার কোমল মনকে আবেগাপ্লুত করে তুলবে। তারপর হয়ত মনের অজান্তেই বলে উঠবেন “এতকাল কেন ভালোবাসিনি নিজেকে?”

এদিকে ট্রেন চলছে আপন গতিতে দিগন্ত থেকে দিগন্ত ছাড়িয়ে। কারো প্রতি কোনো খেয়াল নেই। হয়ত এই ভেবে ছুটেই চলেছে। কী দরকার কারোর সঙ্গের? আমি একাই ছুটব, সব্বাইকে ছাড়িয়ে। জানালার কাছের সিটটা সৌরভের ছিল। প্রকৃতির এমন কোমলতার ছোঁয়া পেয়ে কখন যে ও নিদ্রার জগতে তলিয়ে গেল টেরই পেল না।

এরপরের স্টেশনে ট্রেন থামল। কিন্তু সৌরভের নিদ্রা থামার কোনো লক্ষণ নেই। ও গভীর ঘুমেই নিমজ্জিত আছে। ট্রেন যখন প্রায় ছেড়ে দিবে ঠিক তখনই ঐ কামড়ায় উঠল এক অপরূপা সুন্দরী রমণী এবং সিটটাও একদম সৌরভের মুখোমুখি। যাইহোক মেয়েটি তার নিজ সিটে বসল। আর এদিকে সৌরভ যে কাঁথা মুখে চেপে দিয়ে ঘুমিয়েছে, ঘুমিয়েই আছে। আর কোনো খেয়াল নেই।

হঠাৎ সৌরভ যখন নড়ে শুতে গেল, ওর হাত থেকে ওর উইশবুকটা নিচে পড়ে গেল। ও বুঝতেই পারে নি। মেয়েটা বিষয়টা লক্ষ্য করল। উইশবুকটার ফ্রন্ট পেজটা খুবই সুন্দর ছিল। কিছু ভাবনা চিন্তা ছাড়াই মেয়েটি ঐটা হাতে নিল পড়ার জন্য। আবার ভাবল যে, ঌঌ“এটা কি ঠিক হবে? অন্যের জিনিস এভাবে পড়া অন্যায়। কিন্তু কেন জানি না আমার খুব পড়ার ইচ্ছে হচ্ছে।” তারপর মেয়েটি নিয়ম লঙ্ঘন করে পড়া শুরু করে দিল।
প্রথম লাইনটা এমন ছিল…

“প্রিয় শ্যামোন্বিতা,
আমি কোনো দিন কবিতা লিখিনি। এই প্রথম কারো জন্য কলম হাতে নিলাম। আমার প্রথম কবিতাখানি আমি তোমাকে উৎসর্গ করলাম।

রঙিন বিকেলগুলি হয়ে উঠেছে কেমন যেন ফ্যাকাশে!
নিমীলিত নেত্রে তাকিয়ে থাকি দূর ঐ আকাশে।
সন্ধ্যায় পাখিরাও দেখ, কত সুন্দর ফিরছে নিজ নিজ নীড়ে!
আর আমি!তোমায় পেয়েও হয়ত হারিয়ে ফেলেছি হাজারো ভিড়ে।
রাতের তারাগুলিও দেখ কেমন জ্বলছে মিটিমিটি!
তুমি কি জানো, কতটা মায়াবী লাগে যখন কর তুমি খুনসুটি?
হয়ত কোনো এক বিষণ্ণ অমাবস্যার রাতে,
তুমি এসেছিলে আমাকে এভাবে কাঁদাতে?
মহুয়া ফুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা আজ পুরো শহরখানি!
তুমি কি আভাস পাও না আমার হৃদয়খানির, হে গজদন্তিনী?
মাঝে মাঝে বিষণ্ণতার জানান দিতে ইচ্ছে হয় চিৎকার সুরে!
কিন্তু কে-ই বা শুনবে অবাঞ্চিত কলরব ব্যস্ত এই নগরে?
ক্ষণিকেই বেকে যাবে দুজনের পথ, মুছে যাবে তোমার সমস্ত সংশয়!
এভাবেই আচ্ছাদিত থাকবে তোমার প্রতি আমার অনুভূতির প্রণয়।”

প্রথম লাইন পড়েই শ্যামা একদম থ হয়ে গেল। ওর বুঝতে বাকি রইল না এই উইশবুকটা কার। ঠিক ধরে ফেলেছে। বারবার ও সৌরভের দিকে তাকাচ্ছে কেমন অজানা কৌতুহল নিয়ে। কিন্তু ও এমনভাবে শুয়ে আছে যে বোঝার উপায় নেই।

যাইহোক শ্যামা পড়া শুরু করল আবার,

“জানো শ্যামা, সাধারণ কিছু সবসময়ই আমাকে কেমন যেন টানতো। হোক সেটা জিনিসপত্র বা মানুষ। চাকচিক্য, জাঁকজমকতা কখনোই আমাকে আকর্ষণ করত না। হয়ত একারণেই তোমাকে না চাইতেও ভালোবেসেছিলাম। তোমার সাদামাটা সেই রুপেই কেন জানি বারবার আটকে যেতাম।

সব কিছু ঠিকঠাকই ছিল। আমি কখনো তোমাকে বলতাম না যে আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু তুমি আমাকে বাধ্যই করেছিলে একপ্রকার হার মানতে। তুমি বলেছিলে না হঠাৎ এত চুপচাপ কেন হয়ে গেলাম? কেন এমন পরিবর্তন?

উত্তরটা না-ই দিলাম। কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে না ইচ্ছে হয় না। কি-ই বা হবে দিয়ে। সেই তো একি অবজ্ঞার স্বীকার হতে হবে। আচ্ছা বলতো মানুষ কি মানুষকে সরাসরি বলতে পারে যে, আপনি আমার সাথে যোগাযোগ রাখবেন না বা কথা বলবেন না? ঝগড়া ঝামেলা হলে হয়ত পারে। কিন্তু এমনিতেই কি পারে বলো তো? না পারে না। তবে কি জানো, মানুষ সেটা খুব সুন্দর করে তার ছোট্ট ছোট্ট কথার আঘাত, ছোট্ট ছোট্ট অবহেলার দ্বারা ঠিক বুঝিয়ে দেয় কিন্তু।”

একটা বিষয় খেয়াল করেছেন আপনারা? একটা মানুষ বাধ্য করে আরেকটা মানুষকে পরিবর্তন হতে। তারপর ঐ মানুষটাই এসে পরিবর্তনের কারণ জিজ্ঞাসা করে। খুব হাস্যকর একটা বিষয় না? হ্যাঁ, সবার কাছে হাস্যকর হলেও কোনো একজনের কাছে কিন্তু ভীষণ যন্ত্রণার।

“জানো শ্যামা, নীলক্ষেত আমার অনেক পছন্দের একটা জায়গা। আমার না খুব ইচ্ছে হয় কোনো এক সন্ধ্যায় তুমি আর আমি ঐ নীলক্ষেতে যাই। তারপর দুজন ঐ বইয়ের রাজ্যে হারিয়ে যাই। দুজন দরদাম করে এত্তগুলা বই কিনে নিয়ে আসি। আমাদের একটা বিশাল লাইব্রেরি হবে। তারপর কোনো এক প্রবীণ বয়সে দুজন চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সাহিত্যিক তর্কে জড়াব। কবিতার সুরে দুজন বিতর্কে জড়াব। হারটা না হয় আমিই মেনে নিব শেষে। কিন্তু ইচ্ছেগুলা এই ২০০ পাতার মধ্যেই থমকে থাকবে কে জানত?

কোনো এক কুয়াশায় ঘেরা শীতে, একগুচ্ছ কদম হাতে নিয়ে, গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে কাপতে কাপতে এসে বলি, প্রেয়সী চলোনা, আরো একটা সূর্যোদয়ের সাক্ষী হয়ে থাকি দুজন। পারবে কি আর রাগ পুষে রাখতে তখন?

বসন্ত এসে গেছে, বাতাসে কেমন একটা প্রেম প্রেম গন্ধ। জানো খুব ইচ্ছে হয়, কোনো এক নিস্তব্ধ রাতে তোমার হাতখানি ধরে পুরো শহরখানি ঘোরার। তারপর হাঁটতে হাঁটতে যখন ক্লান্ত হয়ে যাবে তখন এক কাপ চা হাতে নিয়ে দুজন একসঙ্গে স্নিগ্ধ চাঁদখানি অবলোকন করি। কিন্তু ইচ্ছেগুলি এই ২০০ পাতার মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে কে জানত?

আচ্ছা কেমন হতো, দুজনে যদি থাকতাম ছোট্ট এক টিনের ঘরে। বর্ষায় আকাশের বুক চিড়ে যখন বৃষ্টি নামত তখন দুজন জানালার মাঝ দিয়ে উঁকি দিয়ে শনশন করে পড়তে থাকা শিলগুলি দেখতাম। গামছা মাথায় দিয়ে ভিজতে ভিজতে শিল কুড়িয়ে আনতাম। এমন একটা আবহাওয়া, তোমাকে বলতাম, “কি গো হইল তোমার, খিচুড়ি হইতে আর কতক্ষণ।” দুজন একসাথে বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে খিচুড়ি খেতাম। কিন্তু ঐ যে, ইচ্ছেগুলি যে ২০০ পাতায় আটকে থাকবে কে জানত?

ভালো থাকতে গেলে বেশি কিছুর দরকার নেই আসলে। এই যে ছোট্ট ছোট্ট শখ, ছোট্ট ছোট্ট চাওয়া পাওয়া, একটু যত্ন, একটু ভালোবাসা। আর কি লাগে বলুন তো দেখি?মাঝে মাঝে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে অভিমান ভাঙানো। আর কী চাই বলুন তো?”

হঠাৎ সৌরভের ঘুম ভেঙে যায়। উঠে ও ওর উইশবুকটা না পেয়ে খুঁজতে থাকে। তখন দেখে যে ঐটা শ্যামার হাতে। তারপর খুব সাবলীল ভাবেই বলে, “আমার উইশবুকটা?”

শ্যামোন্বিতা সৌরভকে দেখে যতটা অবাক হয়েছিল সৌরভ তার বিন্দু পরিমাণও হয় নি। বিষয়টা শ্যামার মনে কেমন জানি অজানা এক কৌতুহলের জন্ম দিল। তারপর

শ্যামা: আমায় দেখে অবাক হওনি?

সৌরভ: অবাক হবার কি আছে?

শ্যামা: সেদিন যে দূরত্ব বাড়িয়েছিলে আজও সেটা পুষে রেখেছ?

সৌরভ: তুমি তো সেটাই চেয়েছিলে। বাধ্য করেছিলে আমাকে নীরব হতে। শত চাওয়ার পরও আমি আর পারি নি তোমার কাছে যেতে। ভালোই তো হয়েছিল, তো আর কি।

শ্যামা কিছু বলতে পারল না। কেবল নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করল।

সৌরভ: আমার উইশবুকটা।

শ্যামা: পড়া হয়নি তো, আরো অনেকখানি যে বাকি রইল।

সৌরভ: তোমার স্থান ঐ ২০০ পাতার মাঝে আবদ্ধ ছিল না। তোমার স্থান ছিল আমার হৃদয়জুড়ে, আমার সমস্তখানি জুড়ে।
সেদিন একবার পেছনে ফেরে একটু তাকাতে, হয়ত বাকি ইচ্ছেগুলা পড়ার কথা বলতে না। সাক্ষী হয়ে থাকতে আমার সঙ্গে।

এই কথা বলে শ্যামার হাত থেকে খাতাটা নিয়ে চলে যেতে লাগল সৌরভ। শ্যামা কিছুই বলতে পারল না, আসলে বলার সুযোগই দিল না সৌরভ। ও কেবল অপলক চাহনিতে তাকিয়েই থাকল।