fbpx

কাশ্মীর এক বিতর্কিত উত্তরাধিকার: ১৮৪৬-১৯৯০ (১ম খণ্ড : তৃতীয় অধ্যায়)

জম্মু ও কাশ্মীর এবং বৃটিশ ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা : উত্তর সীমান্ত অঞ্চলের সমস্যা

(পূর্ববর্তী সংখ্যায় প্রকাশের পর)

(১৮৯৯ নোটের বিপরীতে) এ নতুন প্রস্তাবগুলো চীনকে খুনজেরাব ও শিমশাল পর্বতমালার পূর্বে কয়েক বর্গ মাইল এলাকার পরিবর্তে তাঘদুম্বাশ পামিরে একটি বিশাল এলাকা দেয়। এই বদান্যতার জন্য ব্রিটিশদের পুরষ্কৃত না হওয়ার কোন কারণ সে সময় কার্জনের চোখে পড়ছিলো না। তিনি এক্ষেত্রে প্রস্তাব করলেন যে, মূল কারাকোরাম জলবিভাজিকার পিছনে বৃটিশদের দাবি প্রত্যাহারের পাশাপাশি কাশগড়ে বৃটিশ কনস্যুলেট উপস্থিতির বিষয়ে চাইনিজদের একটি আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়া উচিত হবে (যার অভাবে জর্জ ম্যাকার্টনি ও তার প্রতিপক্ষ পেত্রভস্কি ও তাদের উত্তরসূরীরা বেশ অসুবিধার মধ্যে ছিলেন)। তবে পিকিং-এ বৃটিশ মন্ত্রী স্যার আর্নেস্ট স্যাটো’র মতে ১৯০৫ সাল চীনের মাটিতে বৃটিশ কনস্যুলেট বসানোর অনুমোদনের জন্য সঠিক সময় ছিলো না। ফলে তিনি তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন ১৯০৪ এ লাসাতে ‘ইয়াংহাজবেন্ড অভিযান’-এর ফলস্বরূপ যে শর্তসমূহ ছিলো সে বিষয়ে চাইনিজ সরকারকে মতৈক্যে নিয়ে আসতে এবং তিব্বতীয়দের সাথে ইয়াংহাজবেন্ড যে ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন সে সমঝোতা চুক্তি গ্রহণ করতে। এ কাজ চাইনিজ কেন্দ্রীয় এশিয়ার কোন অংশে বৃটিশ শক্তি বৃদ্ধির প্রচেষ্টার চেয়ে কোন অংশে সহজতর ছিলো না। হুনজার সীমান্ত ও মর্যাদা উভয়ের পরিবর্তনের জন্য কার্জনের প্রস্তাবের বিষয়ে চাইনিজদের সাথে যোগাযোগই করা হয়নি; ফলে উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তরেখা আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত করার সুযোগও হাতছাড়া হয়।৫১ 

কিছু সময়ের জন্য ম্যাকমোহন বা আরদাঘ মডেলে অগ্রবর্তী সীমান্ত বাতিল হওয়ায় আজঘর, কোকতাশ ও বাশ আন্দিজান-এ মিরের বাৎসরিক অভিজান হিসেবে প্রায় আধ ডজন লোক পাঠানোর মাধ্যমে চাইনিজ প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষকে জ্বালাতন করতে এবং কাশগড়ে রুশ কনস্যুলেটকে বিরক্ত করতে হুনজা’র মিরকে অনুপ্রাণিত করাটা অনেকটা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। ১৯০৫ সালে রাসকামে হুনজার চাষাবাদ বন্ধ হয়। কার্যত বৃটিশরা ১৮৯৯ সালের প্রস্তাবনা ১৯০৫ সালে কার্জন কর্তৃক পরিবর্তিত অবস্থায় একটি সীমান্তরেখা হিসেবে বিবেচনা করেছিলো; এবং মজার বিষয় হচ্ছে এটা ১৯৬৩ সালের ২ মার্চ তারিখে চীন-পাকিস্তান সীমান্ত চুক্তির অত্যাবশ্যকীয় অংশ হিসেবে চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করা হয়েছিলো। ভারতীয় লেখকরা জোর দিয়েই বলেন যে, এই লেনদেনে পাকিস্তান চীনকে কমপক্ষে ২,০৫০ বর্গমাইল জায়গা ছেড়ে দিয়েছে যে বিষয়ে পাকিস্তানের কোন অধিকারই নেই; প্রকৃতপক্ষে, পাকিস্তানের অর্জন এক্ষেত্রে সামান্যই, মাত্র বিশ বর্গমাইল বা তার থেকে কিছু বেশি জায়গা।৫২

তাশকুরঘানে রুশ চৌকি ভারত সরকারের জন্য সময়ে সময়ে মনে একটা খচখচানি হয়েই থাকলো। ১৯০৭ সালের ইংরেজ-রুশ সমঝোতার পর এশিয়াতে এই দুই সাম্রাজ্যের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধ অনেকটাই কমে আসে; যদিও এখানে কিছু কোজাকের অবস্থান ছিলো কিন্তু সেটা বড় ধরনের সংকট তৈরির জন্য যথেষ্ট ছিলো না। ১৯০৮ সালে রুশরা আগের মতো কাশগড়ে চাইনিজ কর্তৃক জর্জ ম্যাকার্টনিকে কনস্যুলার পদবী দিতে আপত্তি করেনি। একই ভাবে, ১৯১১ সালে মাঞ্চু আমলের পরিসমাপ্তি টানা চাইনিজ বিপ্লবের প্রাক্কালে রুশরা যখন তাশকুরঘানে তাদের সামরিক শক্তি ব্যাপক পরিমাণে বৃদ্ধি করলো (যেটা জার আমলের পতনের সাথে সাথে ১৯১৭ সালে চূড়ান্তভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছিলো) তখন ভারত সরকার জোরালোভাবে এ বিষয়ে কোন আপত্তি করেনি।৫৩ ১৯১৬ সালে বৃটিশরা তাঘদুম্বাশ পামিরে গিলগিট স্কাউট-এর সংযুক্ত দল প্রেরণের ন্যায্যতা বোঝাতে চাইনিজ কর্তৃপক্ষের কাছে তাশকুরঘানে রুশ সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিকে পূর্ব নজির হিসেবে তুলে ধরে। রুশদের প্রতি নজর রাখা এ ধরনের শক্তি প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিলো না বরং জিনঝিয়াং এবং ওয়াঝির পর্বতের উপর দিয়ে আফগানিস্তানের ওয়াখান পর্বতাঞ্চলের মধ্যকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নজর রাখা ছিলো উদ্দেশ্য। জার্মান (এবং সম্ভবত তুর্কি) চর, যারা পারস্য এবং আফগানিস্তানে তাদের ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেছিলো বলে জানা গিয়েছিলো, তাদের কর্তৃক এ রুটটা দখল হয়ে যেতে পারে বলে ভারত সরকারের সন্দেহ ছিলো।৫৪

চীনের মাঞ্চু আমলের পতনের অব্যবহিত পরে এবং ১৯০৭ থেকে দৃঢ় হওয়া ইংরেজ-রুশ সম্পর্কের পরম উষ্ণ কূটনৈতিক পরিবেশে ১৯১২ সালে বৃটিশরা ১৯০৭ এর সমঝোতায় পারস্য, আফগানিস্তান ও তিব্বত সম্পর্কিত শর্ত পরিবর্তনের সম্ভাব্য উপায়গুলো খুঁজতে শুরু করে।৫৫ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ খুব সম্ভবত বৃটিশ ভারত শাসকদের মধ্যে সর্বশেষ ব্যক্তি যিনি অগ্রবর্তী সীমান্ত নীতির বিষয়ে প্রবল আগ্রহী ছিলেন। অপর দিকে, ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব স্যার হেনরি ম্যাকমোহন প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে গিলিগিটে রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে অবস্থান করায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এ বিষয়ে অপরিবর্তিতই ছিলো। তিনি মনে করতেন যে, ১৮৯৯ সালের চীনকে লেখা নোটে উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তের যে সীমারেখা উল্লেখ ছিলো তার উত্তরে আরো অগ্রসর হয়ে নিশ্চিত করার তখনই মোক্ষম সময়।

হার্ডিঞ্জ ও ম্যাকমোহন মনে করতেন যে, ১৯১১ এর শেষের দিকে তাশকুরঘান চৌকিতে শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে কাশগড়িয়াতে রুশদের উপস্থিতি বৃদ্ধি বৃটিশদের জন্য আদৌ কোন ঝুঁকি নয় কেননা বৃটিশ ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত এবং রুশ ও চাইনিজ কর্তৃক গৃহীত ছিলো। হার্ডিঞ্জ ও ম্যাকমোহনের মতে, ১৮৯৯ সীমান্তরেখা থাকা সত্ত্বেও (এমন কি ১৯০৫ এ কার্জন কর্তৃক পরিবর্তন করা সত্ত্বেও) এই সীমান্ত অগ্রসর হওয়া উচিত ছিলো: এখানে যেটা প্রয়োজন ছিলো সেটা হচ্ছে “একটা সীমারেখা যা তাঘদুম্বাশ, শহিদুল্লা ও আকসাই চীনকে রুশদের থেকে বাইরে রেখে আমাদের সীমার মধ্যে নিয়ে আসবে”।৫৬

নতুন নীতি বাস্তবায়নে দু’টা বড় সমস্যা ছিলো। প্রথমতঃ উদারপন্থী বৃটিশ সরকার ভারতের সীমানা বৃদ্ধি বিষয়ে যে কোন নীতির বিরোধী ছিলো, যেটা প্রকৃতপক্ষে ১৯০৫ সালে ক্ষমতায় আসার সময় থেকেই। এক্ষেত্রে ১৮৯৯ সীমান্তরেখা পরোক্ষভাবে পুনঃ বিবেচনা করা যেতো যেটা লন্ডনের রাজনীতিবিদদের নজর কাড়তো না। দ্বিতীয়তঃ ১৯১২ সালে যখন ১৯০৭ সমঝোতা পুনঃ বিবেচনার প্রশ্ন উঠলো তখন রুশরা জিনঝিয়াংকে পারস্য, আফগানিস্তান এবং তিব্বতের সাথে যুক্ত করে সীমানা বৃদ্ধির বিষয়ে কোন আগ্রহ প্রকাশ করেনি। সীমানা পুনঃ বিবেচনার বিষয়টি উঠে আসে মূলত ইংরেজ-চাইনিজ প্রচলিত কূটনীতি প্রক্রিয়ার বাইরে। এ সকল বাধার মুখে স্যার হেনরি ম্যাকমোহন কর্তৃক সমস্যার সমাধানগুলো জাহির করাটা এতোটাই বিচক্ষণ ছিলো যে এ যাবৎ ইতিহাসবিদদের নজর এড়িয়েই চলে। এটা দু’টা ধাপে সম্পন্ন হয়েছিলো।৫৭

প্রথম ধাপে, হুনজা’র মিরকে ১৯১৪ সালে আজঘর, কোকতাশ ও বাশ আন্দিজানে রাসকাম জমিগুলোতে পুনরায় চাষাবাদ শুরু করতে উৎসাহিত করা হয়েছিলো। এটা উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তের পশ্চিম প্রান্তে জলবিভাজিকার উত্তর পাশে বৃটিশদের অবস্থান পুনরুদ্ধার করবে এবং ভবিষ্যতে কোন এক সময় সীমানারেখা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন উত্থাপিত হবে সেটা ইংরেজ-চাইনিজ চুক্তির মাধ্যমে অথবা সময়ের প্রয়োজনে অতিরিক্ত সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে।

দ্বিতীয় ধাপে, ১৯১৩ সালের অক্টোবরে বৃটিশ, তিব্বতীয় ও চাইনিজদের মধ্যে শুরু হওয়া শিমলা সমঝোতা আলোচনায় চাইনিজ-তিব্বতীয়দের মধ্যকার সম্পর্কের সংকট সমাধানে (এবং এর সাথে ভারতের জন্য তিব্বতের সাথে আসাম, হিমালয় ও ম্যাকমোহন লাইন বরাবর একটি সন্তোষজনক সীমান্তরেখা অর্জনে) এবং উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তের পূর্ব (লাদাখ) প্রান্ত নিয়ে আপনাতেই আলোচনা উঠতে পারতো। এখানে ম্যাকমোহনের চাল ছিলো আলোচনাকৃত চীন-তিব্বত সীমান্ত উত্তর-পশ্চিম দিকে কুনলুন পর্বতের সাথে আকসাই চীনের দক্ষিণ দিকে বর্ধিত করার  আলোচনায় গতি প্রয়োগে শিমলা সমঝোতা আলোচনায় এ বিষয়ক মানচিত্রকে অন্তর্ভুক্ত করা। চাইনিজরা যদি এ মানচিত্রের বিষয়ে একমত হতো তাহলে তারা দেখতো যে, তারা একটি তিব্বতীয় আকসাই চীনের বিষয়ে একমত হয়েছে (যেটা ভারতীয় পররাষ্ট্র দপ্তর ১৯০৭ সাল থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করছিলো)। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ম্যাকমোহন পরবর্তী কোন এক সময়ে এ পর্বত অঞ্চল (যেটা তিব্বতীয়রা কখনোই দাবি করেনি) তিব্বতীয়দের কাছ থেকে বৃটিশ ভারতের হাতে হস্তান্তর করাতে তিব্বতীয়দের প্ররোচিত করার বিষয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যেহেতু তিনি সে সময় তাওয়াংকে আসাম হিমালয় অংশে হস্তান্তর করানোর প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন; ইতিমধ্যে অবশ্য তিব্বতীয় আকসাই চিন ১৯০৭ ইংরেজ-রুশ সমঝোতার শর্ত মোতাবেক রুশ হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষিত ছিলো।৫৮ এ বিষয়ে ১৯১৪ সালের শিমলা সমঝোতা আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় মানচিত্রের সীমান্তরেখা থেকে সব ধরনের আইনগত শক্তি অপসারণ করা হয়েছিলো যেটা মূলত মানচিত্রের জন্ম দিয়েছিলো। চাইনিজ প্রতিনিধি প্রথমে এ বিষয়ে আলোচনা করলেও পরে পিকিং-এ তাঁর সরকার কর্তৃক তাঁর এ বক্তব্যকে অস্বীকার করা হয়।৫৯

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে হার্ডিঞ্জ-ম্যাকমোহনের প্রচেষ্টার মধ্যে যেটা অবশিষ্ট ছিলো সেটা হচ্ছে রাসকামে মির কর্তৃক হুনজার লোকজনকে পরিদর্শন করা। ১৯০৭ এর ইংরেজ-রুশ সমঝোতা পুনঃ বিবেচনার ক্ষেত্রে শর্ত দ্বারা জিনঝিয়াংকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে রাশিয়ার একমত হওয়ার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা হয়তো ছিলো; কিন্তু তা ১৯১৫ সালে সালে দারদানিলস্ ক্যাম্পেইন ব্যর্থ হওয়ার সাথে সাথে ধূলিসাৎ হয়। আর এ ক্যাম্পেইন ব্যর্থতা বৃটিশদের একটি দর কষাকষির অবস্থান থেকে বঞ্চিত করে যে বিষয়ে কন্সটানটানিপোলের প্রতিশ্রুতি ছিলো এবং এ ব্যাপারে রুশরা প্রকৃতপক্ষে আগ্রহী ছিলো।৬০ ১৯১৬ নাগাদ ভারত সরকারও ১৯০৭ এর সমঝোতার আওতায় জিনঝিয়াং-কে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ বৃদ্ধির বিষয়টি আর অব্যাহত রাখেনি। হার্ডিঞ্জ প্রশাসন-এর উত্তরসূরী হিসেবে ভাইসরয় লর্ড চেলম্সফোর্ড ভারত দপ্তরে ১৯১৬ এর সেপ্টেম্বরে বিষয়টিকে এভাবে উত্থাপন করেন: “রাশিয়ার সাথে বিরোধ পরবর্তী সমঝোতায় চাইনিজ তুর্কিস্তান অন্তর্ভুক্তির যে কোন প্রচেষ্টার বিষয়ে আমরা অসম্মতি প্রকাশ করছি”।৬১ এ বিষয়ে দীর্ঘস্থায়ী ভাবনা ১৯১৭ এর বলশেভিক বিপ্লবের নিচে মাটি চাঁপা পড়ে। চাইনিজ সমঝোতার সমস্ত আশার যবনিকাপাত হয় ১৯২১ সালে।৬২ উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তরেখার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বৃটিশ আন্তর্জাতিক বক্তব্য বলতে ভারত সরকারের কাছে ১৮৯৯ সীমান্তরেখাই অবশিষ্ট রইলো শেষ পর্যন্ত।

১৯১১ সালের চাইনিজ বিপ্লবের পর এবং মাঞ্চু আমলের পরিসমাপ্তিতে জিনঝিয়াং-এর কাশগড় অঞ্চল রুশদের হাতে পড়েনি (যেমনটা হার্ডিঞ্জ ও ম্যাকমোহন অনুমান করেছিলেন)। এর পরিবর্তে এটি প্রদেশের প্রথম প্রজাতন্ত্রী গভর্নর ইয়াং তেং-শিন-এর কঠোর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।৬৩

ইয়াং তেং-শিন ছিলেন ইয়াকুব বেগ রাজত্বকাল জয় করা তো তুং-তাং এর সময় থেকে জিনঝিয়াং রাজনীতির সবচেয়ে ক্ষমতাধর চাইনিজ ব্যক্তিত্ব; এবং কাশগড়ে তাঁর প্রতিনিধিরা ১৯১৪ সালে রাসকামে হুনজার কর্মকাণ্ড পুনরুদ্ধারে প্রবল উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। কয়েক বছর যাবৎ হুনজার আধ ডজন বা এরকম সংখ্যক কিছু লোক বসন্তে ফসল ফলানোর এবং শরৎ-এ ফসল তোলার সময়টা নিরাপদেই রাসকামে কাটাতে পেরেছিলো (খুব সম্ভবতঃ এ সময়ের মধ্যে ২/১ জন লোক পাহাড়ায় নিয়োজিত ছিলো); কিন্তু ১৯১৯ সালে ইয়াং তেং শিন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কাশগড়ের বৃটিশ কনস্যুলেট জেনারেলের কাছে হুনজার কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রতিবাদ জানায় এবং মির-এর রাসকামে কোন অধিকারের বিষয়টি একেবারেই অস্বীকার করে।

এদিকে ভারত সরকার মিরকে তাঁর অধিকার দাবির বিষয়ে উৎসাহিত করতে থাকে। (এই অধিকারের মধ্যে নিশ্চিতভাবে পশু চরানো ও তাঘদুম্বাশ পামির এলাকার খাজনা আদায়ও অন্তর্ভুক্ত ছিলো যেটা ভারত তাদেরকে রাসকাম চাষাবাদের মাধ্যমে উত্থাপিত আঞ্চলিক শর্তের মতো খুব সহজেই ধার দেয়নি।) এ ধরনের অধিকারের অস্তিত্ব এবং চাইনিজ কর্তৃপক্ষের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা জিনঝিয়াং এর বৃটিশ কুটনীতিক দ্বারা নস্যাৎ করা হবে বলে সে সময় মনে হচ্ছিলো। এ সময় আরডাঘ, হার্ডিঞ্জ ও ম্যাকমোহন সমর্থিত সীমান্ত বৃদ্ধি করতে চাপ প্রয়োগের আর কোন ইচ্ছা ছিলো না; তবে কাশগড়ে রুশ প্রভাব পুনরুদ্ধার করাকে প্রতিহত করার প্রচেষ্টা হিসেবে কিছু করাটা নিঃসন্দেহে কার্যকর হতো; কেননা ১৯২৫ সালে কাশগড়ে রুশ কনস্যুলেট পুনঃস্থাপন করা হয়। রুশরা যদি হুনজার ব্যাপারে আর একবার অযাচিত আগ্রহ দেখাতে শুরু করতো তবে ভারত সরকারের কাছেও এ পথ খোলা ছিলো যে, তারা বলশেভিক-প্ররোচিত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রমাণিত (অবশ্যম্ভাবীভাবে ১৮৯৯ এর সীমারেখার আদলে) সীমারেখার পরিবর্তে  কারাকোরাম জলবিভাজিকার পেছনে মির-এর বিভিন্ন অধিকারকে চাইনিজদের হাতে তুলে দিতো।৬৪

জিনঝিয়াং-এ ইয়াং তেং শিন-এর গভর্নর আমলে এমন অবস্থাই ছিলো। ১৯২৮ সালে ইয়াং তেং শিন গুপ্তহত্যার শিকার হন। তাঁর উত্তরসূরী চিন শুজেন এ অস্থির রাজত্ব নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছিলো। ১৯২৫ সালে পুনরুত্থিত রুশ প্রভাবের বাইরেও চিন শুজেনকে সমগ্র চীনের নামমাত্র শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত চিয়াং কাইশেক-এর কুওমিনটাং সরকারের সাথে সম্পর্ককে ঝালাই করতে হতো। উপরন্তু, তাকে রাজ্যের আদিবাসী মুসলিমদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের আগুন প্রশমিত করতে হতো যেটা ইয়াং তেং শিন-এর কঠোর শাসনে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিলো।

উত্তর সীমান্তে চাইনিজ কর্তৃপক্ষের পতনের সাথে সাথে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত আরো অনিরাপদ হয়ে পড়েছিলো; ১৯৩৩ সালে চিন শুজেন রাজত্ব পতনের ফলে বলশেভিক রাশিয়া, জারের রাজত্বের চেয়েও সম্পূর্ণ জিনঝিয়াং রাজ্যের উপর আধিপত্য বিস্তারে অগ্রগামী মনে হচ্ছিলো। ফলে, উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তরক্ষার বিষয়টি ভারত সরকার এবং জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সম্পর্কের নতুন সংস্করণের দাবি নিয়ে খুব দ্রুতই উপস্থাপিত হলো।

[তৃতীয় অধ্যায় সমাপ্ত]

(চলবে)         

৫১. বৃটিশ সরকার ও ভারত সরকার উভয়ই ১৮৯৯ সীমান্ত রেখাকে (১৯০৫ সালে পরিবর্তিত) উত্তরাঞ্চলীয় সীমানা রেখা হিসেবে বিবেচনা করে এবং এ বিষয়ে চাইনিজদের সাথে দর কষাকষির বিষয়ে ঝুলে থাকতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, তবে রুশদের বিষয়ে কী চিন্তা করা হয়েছিলো তা পরিষ্কার না। ১৯০৮ সালে যুদ্ধ দপ্তরের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ কাশগড়িয়ার একটা মানচিত্র তৈরি করে যেখানে এ সীমারেখা সুস্পষ্ট ছিলো; এবং ১৯০৯ এর Aitchison’s Treaties এ এটা রঙিন কালির মানচিত্র হিসেবে সংযুক্ত করা হয়।
৫২. সম্ভবতঃ ১৯৬৩ চুক্তির উদ্দেশ্য ছিলো ১৮৯৯ সীমারেখা ১৯০৫ এর পরিবর্তিত রূপে হুবহু এক রাখা। বাস্তবে জরিপকে সহজ করতে চীন পাকিস্তানকে একটা ছোট ভূমিখণ্ড দিয়ে থাকতে পারে, তবে এটা নিশ্চিত নয় যে এর পরিমাণ বিশ বর্গমাইলের বেশি কি না; এর অবস্থান ছিলো উপরাং জিগলা জলধারা ও খুনজেরাব পর্বতশ্রেণির মধ্যে।
১৯৬৩ চুক্তির বিষয়ে ভারতে সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি জানতে দেখুন: Sangat Singh, Pakistan’s Foreign Policy. An Appraisal, Bombay 1970, p. 113.
১৯৬৩ চুক্তির বিষয়ে একটি উন্নত মানের আলোচনা জানতে দেখুন: J. R. V. Prescott, Map of Mainland Asia by Treaty, Melbourne 1975, Chapter 11.
৫৩. তাশকুরঘান সামরিক চৌকিতে শক্তি বৃদ্ধির বিষয়ে রুশরা ১৮৮১ সালের সেন্ট পিটার্সবার্গ-এর চুক্তি শর্ত চাইনিজদের কর্তৃক ভঙ্গ করাকে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরে। ১৯১১ সালের শেষ দিকে চাইনিজ বিপ্লব ছড়িয়ে পড়লে ১৯১১ সালের আগস্টে আরো কোজাক সৈন্যের সমাবেশ করানো হয়।
৫৪. কারাকোরাম পর্বতের পেছনে তাঘদুম্বাশ পামিরে একটা স্থায়ী উপস্থিতির জন্য বৃটিশ কর্তৃক এ ধরনের স্থাপনা তৈরির এটাই ছিলো এ যাবতকালে প্রথম উদ্যোগ। গিলগিট স্কাউট ডিটাচমেন্ট যেটা রুশ গ্যারিসনের সাথে শীতকালে ছিলো সেটা ১৯১৭ সালে প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৩০ দশকে গিলগিট স্কাউট তাঘদুম্বাশ পামিরে নিয়মিত টহল দিতো; কিন্তু তারা ১৯১৬ সালের মতো আবার কোন চৌকি বসায়নি। C. P. Skrine & P. Nightingale, Macartney at Kashgar. New Light on British, Chinese and Russian Activities in Sinkiang, 1810-1918, London 1973, pp. 255-256 দ্রষ্টব্য।
৫৫. বৃটিশদের দিক থেকে পুনঃ বিবেচনার প্রস্তাব সম্বলিত জরিপ সম্পর্কে জানতে: IOL, L/P&S/18/C.142, Revision of the Anglo-Russian Convention 1907 দ্রষ্টব্য।
৫৬. ১২ সেপ্টেম্বর ১৯১২ তারিখে ক্রো-এর উদ্দেশ্যে হার্ডিঞ্জ এর লেখা সরাসরি উদৃত করা হয়েছে Lamb, China-India Border, op. cit., pp. 107-108 থেকে।
১৯১৪ নাগাদ এই নীতিমালা কিছুটা সংশোধন হয়। এটা মনে হচ্ছিলো যে, সম্ভবত ১৮৯৯ সীমারেখা ভারত-তিব্বতের সীমান্ত হওয়ার সাথে সাথে আকসাই চীন বৃটিশ ভারতের না হয়ে তিব্বতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত হবে। একটা ধারণা ছিলো যে, আকসিই চীনের পশ্চিমের সীমান্ত কারাকোশের নিচে থেকে শুরু হয়ে শহিদুল্লা অঞ্চলের কোন এলাকা দিয়ে পামিরের পাভালো-শেইখোভস্কি চূড়া অথবা এর পার্শ্ববর্তী বেইত পর্বত পর্যন্ত গিয়েছে। তিব্বতীয় আসকাই চীন ধারণার প্রমাণ পাওয়া যায় ম্যাকমোহন যে মানচিত্র চীন ও তিব্বতের অনুমোদনের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন এবং শিমলা সম্মেলনে তা যুক্ত করা হয়। Lamb, Ladakh, op. cit., pp. 13-14; Lamb, McMahon Line, op. cit., Vol. 2, pp. 552-553 দ্রষ্টব্য। খুব সম্ভবতঃ আশা করা হচ্ছিলো যে পরবর্তীতে তিব্বতীয় আকসাই চীন বৃটিশ ভারতে স্থানান্তর হবে।
৫৭. ম্যাকমোহন যে প্রস্তাবটা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেননি সেটা হচ্ছে চাইনিজদের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একমত হতে বলা উচিত ছিলো, যার পরিবর্তে বৃটিশরা চায়না-বার্মা সীমান্তে হ্পিমাউ অঞ্চলে চাইনিজদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করতে পারতো। এই বুদ্ধি পরবর্তীতে চীন কনস্যুলার সার্ভিসে কর্মরত আর্চিবাল্ড রোজ-এর মাথা থেকে বের হয়।
৫৮. এ মানচিত্রে যেখানে শিমলা সম্মেলনে বিভিন্ন সীমারেখা অঙ্কন করা হয় সেখানে স্কেল ছিলো ১: ৩,৮০০,০০০; এবং এটা অন্য মানচিত্র (দুই পাতায়) যার স্কেল ১: ৫০০,০০০ তার সাথে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। এ মানচিত্রের উপর ভিত্তি করে ম্যাকমোহন লাইন গোপনে ঐ সম্মেলনে বৃটিশ ও তিব্বতীয়দের দ্বারা সমঝোতা করা হয়।
শিমলা সম্মেলনের মানচিত্রের প্রথম সংস্করণ কুনলুন আদলসহ নভেম্বর ১৯১৩ তে প্রথম প্রকাশিত হয়। তিব্বতীয়রা ১৯১৪ এর ফেব্রুয়ারিতে বৃটিশদের কাছে তাওয়াং হস্তান্তর করতে রাজি হয় এবং হস্তান্তর প্রক্রিয়া ১৯১৪ এর ২৪ ও ২৫ মার্চে গোপন নোটের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। ঐ সময় পর্যন্ত একটা উল্লেখযোগ্য মনাস্টারি সহ তাওয়াং নিঃসন্দেহে তিব্বতীয় অঞ্চলভুক্ত ছিলো। যতটা বোঝা যায় তিব্বতীয়রা কখনো আসকাই চিন দাবি করেনি।
মানচিত্রের “লাল রেখা” অসচেতন ভাবে নিজেদের সুবিধার জন্য তুলে দেয়া হয়। চাইনিজদের ম্যাকমোহন লাইন, আসাম হিমালয়ে ভারত-তিব্বত সীমান্ত মেনে নেয়াটা প্রকৃতপক্ষে শিমলা সম্মেলন আলোচনার বিষয়বস্তু ছিলো না।
ইংরেজ-রুশ সম্মেলন ১৯০৭ এর তিব্বত অধ্যায়ের আর্টিকেল ১ এ বলা হয়েছে: “দুই পক্ষের উচ্চ পর্যায় থেকে তিব্বতের আঞ্চলিক অখণ্ডতার স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে এবং অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে একমত হয়েছে।
৫৯. শিমলা সম্মেলন এর ইতিহাস বিস্তারিত যাচাই করা হয়েছে: A. Lamb, The McMahon Line. A Study in the Relations Between India, China and Tibet 1904-1914, 2 vols., London 1966। উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তের জন্য শিমলা সম্মেলন মানচিত্রের ফলাফল আলোচনা করা হয়েছে- পৃষ্ঠা: ৫৫৩-৫৫৯।
৬০. যুদ্ধ পরবর্তী সমঝোতার অংশ হিসেবে ১৯১৫ এর মার্চে কন্সট্যানটিনোপোলকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে প্রস্তাব করা হয়। এটা ভালো হতো যদি এ ধরনের সমঝোতায় জিনঝিয়াংকে অন্তর্ভুক্ত করা হতো, যদিও আগস্ট ১৯১৫ তে ভারত দপ্তরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো “সার্বিকভাবে এ সম্পর্কে হুনজা প্রশ্ন উত্থাপন করে খুব সামান্যই অর্জন করা গেছে।”
৬১. L/P&K/18/C 163, India to India Office, 29 September 1916.
৬২. শিমলা সম্মেলনের পরবর্তী অংশ আলোচনা হয়েছে: Alastair Lamb, Tibet, China & India 1914-1950. A History of Imperial Diplomacy, Hertingfordbury 1989।
৬৩. R. Yang, “Sinkiang under the administration of General Yang Tseng-hsin, 1911-1928”, Central Asiatic Journal, 1961 দ্রষ্টব্য।
৬৪. চায়না-রুশ চুক্তি ১৯২৪ এর কারণে রুশরা জিনঝিয়াং-এ বেশ কিছু কনস্যুলেট খুলে এবং এর রাজধানী উরুমকিতে একজন কনস্যুলেট জেনারেল বসায়।
ব্যবস্থাপক |

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশন:১৯৯৯-২০০০

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০