২০১৭ সালের বসন্তের শুরুতে চারপাশে বেশ রং লেগেছে। বসন্তেরই রং। সাথে ভালোবাসা দিবসেরও বটে। ইংরেজি সালের হিসেবে বসন্ত বলছি এই জন্য কারণ বাঙালিরা আজকাল বাংলা হিসেবে খুব একটা আরাম পায়না বললেই চলে। ১৩ ফেব্রুয়ারিতে পহেলা ফাল্গুন আসে এটাই নিয়ম। মনে মনে সেই হিসেবটা কষেই সবাই বাসন্তি রঙের মিছিলে বের হয়। আসলে এই বাড়াবাড়িটা খারাপ লাগে না। উৎসব পালনে এমন গোঁড়ামি অতলামী ছাড়া আর কিছু না। যাহোক, ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে তখনও উৎসবের আমেজ। ভালোবাসা দিবসের এক্সটেন্ডেড দিন হিসেবে পালন করছে প্রেমিক-প্রেমিকারা। ১৪ ফেব্রুয়ারি যারা বাড়িতে ধরা খাবার ভয়ে হোক কিংবা নিয়মের বাইরে গিয়ে হোক, কোন একটা কারণে সেজেগুজে প্রিয় মানুষের সাথে বেরোতে পারেনি তারা পরের দিন বেশ সেজেগুজে বেরিয়েছে। কার্জন হলে দু’একটা পলাশের ডালে বসে হয়তো কোকিলও ডাকছে। চারিদিকে উৎসব। প্রত্যেক বছর সাধারণত তাই হয়। এমনটাই নিয়ম। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর খপ্পড়ে পড়ে কবে এই নিয়ম চেইঞ্জ হয়ে যাবে বলা যাচ্ছেনা এখনই।
যাহোক, হলেই ছিলাম আমি। দিন দুয়েক পর ইকোনোমেট্রিক্স পরীক্ষা। তার একদিন পর টাইম সিরিজ এনালাইসিসের ব্যাকলগ পরীক্ষাও আছে। বিরাট টেনশনের ব্যাপার। পড়ালেখা না করে টেনশনটাই করছিলাম কেবল। এমন সময়, সারওয়ার ভাইয়ের ফোন আসলো। সারওয়ার ভাই ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাই। আমার চেয়ে অনেক সিনিয়র। ডিপার্টমেন্টের ম্যাগাজিনে কাজ করার সময় পরিচয় হয়েছিল তাঁর সাথে। আমার অলসতার জন্যই হোক কিংবা ইন্ট্রোভার্টনেসের কারণেই হোক, কারো সাথেই সেভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলা হয়না আমার। কিন্তু তাঁর সাথে প্রায়ই যোগাযোগ হয় আমার। ভীষণ রকমের ভালো মানুষ। ফোন ধরতেই ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললেন, ফ্রি আছি কিনা! অল্প কিছুক্ষণের জন্য পিজি হসপিটালে (BSMMU) যেতে হবে, উনার বসের ইউনিভার্সিটির একজন জুনিয়র ওখানে ভর্তি আছে। ক্যান্সার হয়েছে। তবে অবস্থা বেগতিক। যখন তখন এক্সপায়ার করে যেতে পারে। বলা যাচ্ছেনা কিছুই। সাথে ছেলেটার মা ছাড়া কেউ নেই। একা একা কিছুই সামলে উঠতে পারছেন না। বসের সাথে সারওয়ার ভাইও হসপিটালে আসছেন কিন্তু জ্যামের কারণে রাস্তায় আটকে আছেন। ঘন্টাখানেক লাগতে পারে। এই সময়টুকু কেউ গিয়ে একটু সাহায্য করলে খুব উপকার হয়।
আমি শুনেই হসপিটালের দিকে রওনা হলাম। ওয়ার্ড নাম্বার খুঁজে বের করে ভেতরে ঢুকলাম। ছেলেটার নাম ছিল ফয়সাল। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র। ওর সম্পর্কে এতোটুকুই সারওয়ার ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম রিক্সায় যেতে যেতে। ফয়সালের বেডের কাছাকাছি এগোতেই বুঝলাম কিছু একটা ঘটে গেছে। কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে বেডের কাছে। বেশির ভাগই নারী। তারা অন্য বেডের রুগিদের আত্মীয়। ফয়সাল বেডে শুয়ে আছে। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হল না। কাছ থেকে দেখে বুঝলাম শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে না। বুঝলাম, ও মারা গেছে। আরও বুঝলাম আমার বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে চলেছে। সারওয়ার ভাই সম্ভাব্য ঘটনা বলে দেবার পরেও আমি প্রস্তুত ছিলাম না। ফয়সালের মা পাশে রাখা টুলে বসে আছেন দেয়ালে হেলান দিয়ে। চোখ দু’টো বন্ধ। দুই গাল গড়িয়ে পানি চলে গেছে বোঝা যাচ্ছে। আশেপাশে দাঁড়ানো কেউই কিছু বলছেন না কিংবা করছেন না। কেবলই দাঁড়িয়ে আছেন সবাই। আমি দু’পা এগিয়ে সাহস করে ফয়সালের মায়ের মাথায় হাত রাখলাম।
উনি তাকালেন আমার দিকে। বললেন, বাবা, তুমি কি ফয়সালের বন্ধু!?
হ্যাঁ বলবো নাকি না বলবো বুঝে ওঠার আগেই উনি আমাকে ধরে কাঁদতে লাগলেন। এতক্ষণ পরিবেশটা থমথমে ছিল। এবার কান্নার চিৎকারে ওই ওয়ার্ডের গুমোট বাতাস কেঁপে উঠলো। আমি কী করবো, কী বলবো কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না কয়েক মিনিট।
ফয়সালের মায়ের কান্না হঠাৎ থেমে গেল। দেখলাম, উনি মূর্ছা গেছেন। পানি চাইলাম একজনের কাছে। পাশে রাখা পানির বোতল একজন এগিয়ে দিল। বোতল খুলে অল্প একটু পানি উনার মুখে ঝাপ্টা দিলাম। উনি চোখ খুললেন। একটু পানি খাওয়ার অনুরোধ করলাম। কিন্তু অমন সময় এসব অনুরোধ করে আসলে কোন লাভ হয় না। দাঁত-মুখ বন্ধ করে ওই অবস্থায়ই বসে রইলেন। আশেপাশে কোন গ্লাস কিংবা কাপ না দেখে বোতলের ক্যাপেই পানি ঢেলে উনার মুখে দেয়ার চেষ্টা করলাম। অল্প কিছু পানি হয়তো গেল কিন্তু বেশির ভাগই পড়ে গেল।
এভাবে কয়েক ক্যাপ পানি দিলাম। দাঁড়িয়ে থাকা একজন মহিলা হঠাৎ আমাকে বলে উঠলেন, লাশের পা দুটো দু’দিকে ছড়িয়ে আছে। সোজা করে দাও। চোখ দু’টোও খোলা। বন্ধ করে দাও। ফয়সালের মাকে উঠিয়ে বেডের পাশেই এককোণে রাখা একটা চেয়ারে বসালাম। উনি উঠতে পারছিলেন না অথবা চাইছিলেন না। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে পারা গেল।
এরপর ফয়সালের দিকে তাকালাম। মনে হলো জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। দেরি না করে দু’দিকে কিছুটা ছড়ানো পা সোজা করে দেয়ার জন্য যেই ওঁর পা দুটো ধরলাম। আমার শরীরটা কেঁপে উঠলো। তখনও ওর শরীর খুব একটা ঠাণ্ডা হয়ে যায়নি। তাপমাত্রার তারতম্য বুঝে উঠতে পারলাম না। তারপরেও মনে হলো অত ঠাণ্ডা শরীর আমি কখনও স্পর্শ করিনি। মৃতদেহ কখনও স্পর্শ করিনি। পা দু’টো সোজা করলাম। কিন্তু দু’মুখো হয়ে পা দুটো হেলে রইলো। সোজা হলো না। আসলে আমি পারলাম না সোজা করতে। ততক্ষনে ফয়সালের মামা এসেছেন একজন নার্স নিয়ে। প্রস্রাবের জন্য যে নল লাগানো আছে সেটা খুলে দেবে নার্স। ফয়সালের মামা আসার পর আমি এক সাইডে দাঁড়ালাম। চোখ দু’টো বন্ধ করালেন উনি। ফয়সালের বাবাও আসলেন। পাশে ফয়সালের মা কাঁদছিলেন আবারও। বিলাপ করছিলেন। সাথে যোগ হলো ফয়সালের বাবার।
এরপর আরও বেশ খানিকটা সময় যাবার পর একটা সময় ফয়সালের লাশ ট্রলিতে তোলার পর ওর মাকেও একটা হুইল চেয়ারে করে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। ততক্ষণে ফয়সালের বন্ধুবান্ধব এসেছে। আমি ভিড়ের পেছনে দাঁড়ানো। ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে একটা বড় লিফটে নেয়া হলো। আমি আর ওই লিফটে না উঠে অন্য একটা লিফটে করে নীচে আসলাম। সারওয়ার ভাই এসেছেন উনার বসের সাথে। কথা হলো উনাদের সাথে। সাথে একজন লোক ছিলেন, যিনি ফয়সালকে চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়ায় নিয়ে যাবার জন্য সব কাগজপত্র প্রিপেয়ার করছিলেন। একদিন আগে ফয়সালের পাসপোর্টের কাজও করে গেছেন। উনি বলছিলেন, ছেলেটা বলছিল যে আপনারা এতো চেষ্টা করছেন, হয়তো কোন লাভ হবেনা। তার আগেই সব শেষ হয়ে যাবে। ওর বোন মাস ছয়েক আগে স্কলারশিপ নিয়ে ইউএসএ গিয়েছিল পড়তে। দেখা করার ইচ্ছা ছিল। বোন আসার ব্যবস্থাও করছিলেন, তার আগেই মারা গেলো ছেলেটা।
লাশের এম্বুলেন্স রেডি হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল প্রায়। এসেছিলাম দুপুর তিনটার দিকে। মাঝে ঘন্টা তিনেক সময় গেছে। অথচ মনে হচ্ছিল হাজার বছর সময় লেগেছে। মাথা ঝিমঝিম করছিল। সারওয়ার ভাইকে বিদায় বলে বাইরের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
এরপরের অনেকগুলো রাত আমার ঠিকমতো ঘুম হতো না। জানালার বাইরে ফয়সালের তাকিয়ে থাকা চেহারা চোখের সামনে ভাসতো। চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাতাম। রুমে লাইট জ্বললে চাদরের ক্ষুদ্র ছিদ্র গুলো দিয়ে মোজাইক একটা দৃশ্য দেখতাম। মনে হতো তেলাপোকাও তো আলোতে এমন দৃশ্যই দেখে। মানুষ হয়ে কী দেখছি! আর অন্ধকার থাকলে দেখতাম, ছোটবেলায় বাড়িতে ছাদে কাপড় শুকানোর তারে আম্মুর সুতি শাড়ি গুলো যখন ঝুলতো আর আমি সেখানে লুকানোর চেষ্টা করতাম, নিজেকে জড়িয়ে ফেলতাম অথবা ছাদের ইটের রেলিংয়ে এইমাত্র শুকাতে দেয়া শাড়ির একেবারে শেষ প্রান্ত থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে আর আমি ঠিক নীচে দাঁড়িয়ে আছি। এক দু ফোঁটা পানি আমার মুখে এসে পড়ছে। এমন দৃশ্য। কি ভয়াবহ সময়ে আদুরে একটা ছোঁয়া খোঁজার চেষ্টা!
ফয়সালের সেই জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকা চেহারাটা এখনও মাঝে মাঝে মনে হয়। কিছুটা বিষণ্ণতা আসে বটে, তবে আগের মতো তাড়িয়ে বেড়ায় না। এই ব্যাপার গুলো অদ্ভুত। একেকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আর জীবনের ডিস্ট্রিবিউশনের কিছুটা মেমরিলেস প্রোপার্টি।
- সাকিব ইবনে সালামhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a7%8b%e0%a6%83-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%ac-%e0%a6%87%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%87-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae/বুধবার, জুলাই ১, ২০১৫
- সাকিব ইবনে সালামhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a7%8b%e0%a6%83-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%ac-%e0%a6%87%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%87-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae/বৃহস্পতিবার, মে ৯, ২০১৯
- সাকিব ইবনে সালামhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a7%8b%e0%a6%83-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%ac-%e0%a6%87%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%87-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae/বৃহস্পতিবার, জুন ১৩, ২০১৯
- সাকিব ইবনে সালামhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a7%8b%e0%a6%83-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%ac-%e0%a6%87%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%87-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae/বৃহস্পতিবার, জুন ১৩, ২০১৯