fbpx

দ্য মেলন ড্রপ

(১)

দেয়ালে ঝোলানো আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখছে চৈতী। আহামরি সুন্দরী না হলেও দেখতে মন্দ নয় ও। কিন্তু, আজকের প্রতারণার পরিকল্পনা সফল হতে হলে ওকে আলো ছড়াতে হবে।

চৈতীর বয়স এখন পঁচিশ। মাস্টার্স পাস করে বেকার বসে আছে। তবে, পুরোপুরি বেকার ওকে বলা যায় না – একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে গণিতের বদলী শিক্ষক হিসেবে মাঝে মাঝে ক্লাস নেয় ও।

গত এক ঘন্টা ধরে অনেক যত্ন করে নিজেকে সাজিয়েছে চৈতী। পরেছে বাসন্তী-রঙ চিনন-সিল্কের কামিজ, সাথে ম্যাজেন্টা রঙের লেগিংস। বাসন্তী আর ম্যাজেন্টা – দুই রঙের ওড়নাটি গলার কাছে তুলে দেয়া।

চৈতীর মা অনেক ব্যাপারে উদার হলেও ওড়না ‘ঠিকমত’ না পরলে তিনি রেগে যান। তার ভাষায়, ওড়না তো গামছা নয় যে ঘাড়ের উপর দিয়ে এনে শরীরের দুপাশে ঝুলিয়ে রাখবে। এটা মাফলারও নয় যে গলায় পেঁচিয়ে রাখবে। এটার কাজ গলা ঢাকাও নয় যে এটাকে গলার কাছে তুলে দিতে হবে। তবে, আজ মা ওকে কিছু বলবেন না। অনেক অনুরোধ করে আজকের দিনটা নিজের মত করে পেয়েছে ও।

আজকের পরিকল্পায় চৈতীকে সাহায্য করবে ওর ছোট বোন দীপ্তি। তার বয়স পনেরো, ভিকারুন্নেসা নুন স্কুলে ক্লাস টেনের ছাত্রী। স্কুল ড্রেস পরে তৈরি হয়েছে সে – সাদা সালোয়ার, আকাশি কামিজ, সাদা ওড়না।

পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গতকাল বিকেলে দু শ টাকায় একটা ফুলদানী কিনে এনেছে দীপ্তি। রিসিটে দাম লিখিয়েছে চার হাজার আট শ টাকা। বাসায় এসে প্যাকেট খুলে ফুলদানীটা বের করে ভেঙে তিন চার টুকরো করে আবার প্যাকেটে ঢুকিয়েছে। এরপর ভাল কোয়ালিটির র‍্যাপিং পেপার দিয়ে প্যাকেটটা গিফ্ট্-র‍্যাপ করেছে।

ওরা দু বোন আজ লোক ঠকানোর যে কৌশলটি প্রয়োগ করতে যাচ্ছে, তার নাম ‘মেলন ড্রপ’। গত দু দিন ধরে ওরা মেলন ড্রপ নিয়ে ইন্টারনেটে যা পেয়েছে পড়ে ফেলেছে। এক সময় জাপানে তরমুজের দাম ছিল আকাশছোঁয়া। তখন ব্রিটেনে জাপানি ট্যুরিস্টদেরকে ঠকানোর জন্য তরমুজের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এক বা দুই পাউন্ড দিয়ে একটি তরমুজ কিনে ব্রিটিশ প্রতারক জাপানি ট্যুরিস্টের সাথে ধাক্কা লাগিয়ে তরমুজটি এমনভাবে হাত থেকে ফেলে দিতো, যাতে এটা ফেটে চৌচির হয়ে যায়। তারপর, জাপানি ভদ্রলোকের কাছ থেকে তরমুজের দাম বাবদ চল্লিশ পঞ্চাশ পাউন্ড আদায় করা হতো (জাপানে তরমুজের দাম তখন চল্লিশ পাউন্ডের বেশিই ছিলো)

আজকাল তরমুজের বদলে অন্যান্য জিনিস ব্যবহার করা হলেও নামটা মেলন ড্রপই রয়ে গেছে।

প্রতারকদের নানা কৌশলের কথা চৈতী প্রথম শুনেছে হিমেলের কাছে। ভার্সিটিতে ওর এক ব্যাচ আগের ছাত্র হিমেল এখন ঢাকা ব্যাংকের কাকরাইল শাখায় সিনিয়র অফিসার পদে চাকুরি করছে। মেলন ড্রপ, পিজিয়ন ড্রপ, ল্যান্ডলর্ড কন – এ রকম নানা প্রতারণার কথা পড়ে অবসর সময় কাটায় সে।

চৈতীর বান্ধবীরা বলে হিমেল ওকে অনেক পছন্দ করে। চৈতীও এটা বোঝে। কিন্তু, হিমেল এখনও সরাসরি কিছু বলেনি।

চৈতী আর দীপ্তির আজকের পরিকল্পনাটা মোটামুটি এরকম। সকাল সাড়ে নটায় শান্তিনগর মোড়ে যাবে ওরা। রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে মানুষের নজর আকর্ষণ করবে চৈতী। যে সব পথচারীর মনোযোগ ওর দিকে থাকবে, তাদের মধ্যে ধনী (অন্তত: পোশাকে আশাকে ধনী মনে হয় এমন) একজনকে মার্ক (টার্গেট) হিসেবে বেছে নিবে দীপ্তি। ভদ্রলোক যখন চৈতীকে দেখতে দেখতে হাঁটবেন, তখন দীপ্তি তার সাথে ধাক্কা লাগিয়ে ওর হাতের প্যাকেট ফেলে দিবে। এরপর ‘ভেঙে যাওয়া’ ফুলদানীর দাম আর যাতায়াত ভাড়া বাবদ পাঁচ হাজার টাকা আদায় করবে ভদ্রলোকের কাছ থেকে।

(২)

শান্তিনগর মোড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে দাঁড়িয়ে আছে চৈতী। এমন একটি জায়গা বেছে নিয়েছে, যাতে বেইলী রোড থেকে বের হয়ে কোন পথচারী ডানে ঘুরলে প্রথমেই ওকে চোখে পড়ে। দীপ্তি দাঁড়িয়ে আছে ওর থেকে কয়েক গজ দক্ষিণে, বেইলী রোডের দিকে ফিরে। দুহাতে ফুলদানীর প্যাকেটটা ধরে আছে সে।

নিজেকে নিয়ে গর্ব হচ্ছে চৈতীর। রাস্তা দিয়ে যারাই হেঁটে যাচ্ছে, ওর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাচ্ছে। তবে, সবার অতিরিক্ত মনোযোগে একটু বিব্রত বোধ করছে ও। একটু ভয়ও লাগছে।

ঘড়ি দেখলো চৈতী। নয়টা চল্লিশ। আনুমানিক মিনিট পাঁচেক পরে ওদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হবে।

কয়েক মিনিট পর চৈতী হঠাৎ দু হাত তুলে চুলের ব্যান্ড ঠিক করতে লাগলো। এটা ওদের প্ল্যানের অংশ। এতে একসাথে দুটো কাজ হলো। দীপ্তি বুঝতে পারলো সময় হয়েছে। আবার, চৈতীর উপর পথচারীদের মনযোগ বেড়ে গেল।

দীপ্তি টার্গেট হিসেবে প্রৌঢ় এক ভদ্রলোককে বেছে নিলো – পোশাক দেখে তাকে অভিজাত মনে হচ্ছে, তাছাড়া ডান দিকে তাকিয়ে চৈতীকে দেখতে দেখতে দীপ্তির দিকে হেঁটে আসছেন তিনি।

দ্রুত পায়ে টার্গেটের দিকে এগিয়ে গেল দীপ্তি, লোকটার বাম হাতের সাথে ধাক্কা লাগিয়ে হাতের প্যাকেটটা মাটিতে ফেলে দিলো। আঁতকে উঠে ভদ্রলোক প্রথমে দীপ্তিকে, পরে মাটিতে পড়ে থাকা প্যাকেটটা দেখলেন। মিন মিন করে বললেন, ‘স্যরি’।

দীপ্তি মুখ কালো করে মাটি থেকে প্যাকেটটা তুললো, তারপর দ্রুত হাতে প্যাকেটটা খুলে ফেললো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো, ‘আপনি ফুলদানীটা ভেঙে ফেলেছেন! আপনি অন্য দিকে তাকিয়ে হাঁটছিলেন।’ পরের কথাগুলো বললো যাতে টার্গেটের মনে অপরাধবোধ তৈরি হয়।

‘স্যরি,’ আবার বললেন ভদ্রলোক। ‘আমি এটার দাম দিয়ে দিচ্ছি।’ দীপ্তি যা ভেবেছিল, কাজটা তার চেয়ে সহজ হচ্ছে!

চৈতী এই মুহূর্তে দীপ্তি বা টার্গেটের দিকে তাকাচ্ছে না। কারণটা রঙ্গমঞ্চে হিমেলের প্রবেশ। কী ঘটছে অনুমান করে অবাক হয়ে চৈতীর দিকে তাকিয়ে আছে সে। একবার কথা বলতে গিয়েও থেমে গেছে। মনে হয় কথা খুঁজে পাচ্ছে না। তবে, ওর দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় কুঁকড়ে গেছে চৈতী।

‘ওড়না ঠিক করো,’ অবশেষে বললো হিমেল। কণ্ঠে রাগ।

চটপট ওড়না ঠিকমত পরলো চৈতী। টার্গেটের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দীপ্তি ওর দিকে এগিয়ে আসছিলো, কিন্তু হিমেলকে ওর সাথে কথা বলতে দেখে থেমে দাঁড়িয়েছে।

ঘাড় ঘুরিয়ে দীপ্তির দিকে তাকালো হিমেল। চৈতী বললো, ‘ও হলো দীপ্তি। আমার ছোট বোন।’

দীপ্তির সালামের উত্তরে মাথা ঝাঁকালো হিমেল। বললো, ‘তোমাকে আমি চিনি। ছবি দেখেছি।’ তারপর চৈতীর দিকে ফিরে বললো, ‘তোমার সাথে কথা আছে।’

‘তুই যা,’ দীপ্তিকে বললো চৈতী।

(৩)

বেইলী রোডে ‘ক্যাফে অপিয়াস’ এর একটা কর্ণার টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে চৈতী আর হিমেল। অফিসে ফোন করে ছুটি নিয়েছে হিমেল।

‘মেলন ড্রপ কবে থেকে শুরু করেছো?’ জানতে চাইলো হিমেল। বোঝা যাচ্ছে, এখনও রেগে আছে সে।

‘আজই,’ বললো চৈতী।

‘কেন?’ চৈতী চুপ করে আছে দেখে যোগ করলো, ‘টাকা পয়সার টানাটানি যাচ্ছে?’

চৈতী চুপ করেই থাকলো।

‘টাকার দরকার হলে আমাকে বলোনি কেন?’ অধৈর্য হয়ে জানতে চাইলো হিমেল।

‘টাকার দরকার হলে আপনাকে বলবো! আমি আপনার কী হই?’ চৈতীর চোখে হঠাৎ পানি।

‘তুমি আমার কী হও, তুমি জানো না?’ হিমেলের কণ্ঠে বিস্ময়।

‘জানবো কী করে? আপনি কখনও বলেছেন?’

‘সরাসরি বলতে হবে? তুমি বোঝ না?’ আবার রেগে গেছে হিমেল।

‘না, বুঝি না,’ বললো চৈতী। এবার ওর কন্ঠেও রাগ।

‘তুমি এমন বোকার হদ্দ তা তো জানতাম না।’

‘কখনও সরাসরি বলেননি, বুঝতেও দেননি। কিছুদিন আগে আপনাকে বললাম, বাবা একটা ছেলের সাথে আমার বিয়ের কথাবার্তা বলছেন, আমি কী করবো? আপনি কী বললেন? বললেন, বিয়ে করতে চাইলে করে ফেলো!’

‘ছেলেটাকে বিয়ে করতে না চাইলে তোমার বাবাকেই তো না করতে পারতে। তা না করে আমাকে বলেছিলে কেন?’

‘আপনার এত বুদ্ধি, এটা বোঝেন না? বাবাকে কী বলবো আমি – এই ছেলে নয়, অন্য ছেলে দেখুন?’

‘কেন, বলতে পারোনি, তোমার পছন্দের ছেলে আছে?’

‘আমার পছন্দের ছেলে থাকলে তো হবে না। আমাকেও তো সেই ছেলের পছন্দের মেয়ে হতে হবে, তাই না? আপনি কেন সেদিন বলেননি, “বাসায় বলে দাও অন্য একটা ছেলে তোমাকে পছন্দ করে?” তাহলে তো বুঝতাম, আমি আপনার কী হই।’

চুপ করে রইলো হিমেল।

আবার শুরু করলো চৈতী, ‘এমন ঘটনার কথাও তো শুনেছি – মেয়ে নিশ্চিত ছেলে তাকে পছন্দ করে, কিন্তু বিয়ের কথা তোলাতে ছেলে বললো “আমি তো দু তিন বছরের মধ্যে বিয়ে করবো না” বা “আমি তো তোমাকে বোনের মত দেখি”। আসলে মেয়েটা হয়তো ছিল ছেলেটার সময় কাটানোর একটা উপায় মাত্র।’

‘তোমার কথা বুঝলাম,’ বললো হিমেল, ‘আমার ভুল হয়েছে – তোমাকে সরাসরি বলা উচিত ছিলো। কিন্তু, তাই বলে টাকার দরকার থাকলেও আমাকে বলা যাবে না? মেলন ড্রপ করতে হবে?’

‘প্রথম কথা, আমাদের সম্পর্ক প্রেমিক-প্রেমিকার নয়, এখনও আপনি-তুমিতে পড়ে আছে। প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক  থাকলেও টাকা চাইতে পারতাম না। স্বামীর দায়িত্ব স্ত্রীর খরচ বহন করা, কিন্তু প্রেমিকার খরচ বহন করা প্রেমিকের দায়িত্ব নয়।’

‘তার মানে কী? টাকার দরকার হলে মেলন ড্রপ করবে?’ হিমেলের কন্ঠে আবার রাগ।

চুপ করে রইলো চৈতী।

হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো হিমেল। বললো, ‘চলো।’

‘কোথায়?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলো চৈতী।

‘আজই বিয়ে করবো। এক্ষণি।’

(৪)

দুপুর বারোটার দিকে মাকে কল করে বিয়ের খবরটা দিলো চৈতী। মা কাঁদতে শুরু করলেন, তবে এটা খুশির কান্না বলেই চৈতীর ধারণা। এমন নয়, মা হঠাৎ করে ধাক্কা খেয়েছেন। মাকে ও আগেই বলে রেখেছে, হিমেল ভাইয়া যখন যেভাবে বিয়ে করতে চায়, বিয়ে করবো। ওর অনুরোধে মা সেটা বাবাকেও বলে রেখেছেন। হিমেল সম্পর্কে বিস্তারিত শুনে, আর চৈতীর মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে তাঁরা সেটা মেনেও নিয়েছেন।

এরপর চৈতী ফোন করলো দীপ্তিকে। খবরটা শুনে দীপ্তি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। বললো, ‘যখনই হিমেল ভাইয়া বললেন, “ওড়না ঠিক করো” – আমার মনে হলো তাকে নিয়ে তুমি অনর্থক দুশ্চিন্তা করেছো। আপু, এখন তোমাদের প্ল্যান কী?

‘ওর ইচ্ছে আজই বিকেলের ফ্লাইটে কক্সবাজার যাওয়া। কাল বৃহস্পতিবার ছুটি নিয়েছে। রোববার ভোরের ফ্লাইটে এসে অফিস করবে।’

‘আমার আইফোন কবে পাবো, আপু?’ দীপ্তির কণ্ঠে আগ্রহ।

‘আইফোনের টাকা তোর পড়ার টেবিলের ডানদিকের ড্রয়ারে রেখে এসেছি। পছন্দ মত কিনে নিস।’

‘আগেই টাকা দিয়ে দিয়েছো!’ দীপ্তি খুশিতে নাচছে। ‘যদি প্ল্যানটা সাকসেস্ফুল না হতো?’

‘তোর প্ল্যানে কাজ না হয়ে উপায় আছে? তুই হলি বর্ন সাইকোলজিস্ট। ও হ্যাঁ, আংকেলের পাঁচ হাজার টাকা ফেরত দিতে পেরেছিস?’

‘হ্যাঁ, দিয়েছি,’ বললো দীপ্তি। ‘তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাড়াতাড়ি হেঁটে গিয়ে তাকে পেয়েছি। একটু অবাক হলেন টাকা ফেরত পেয়ে। তাঁকে বললাম, স্যরি আংকেল, এটা ছিল একটা প্র্যাকটিক্যাল জোক।’

‘যাক, সব ভালভাবেই হলো। এখন রাখি দীপ্তি। ও ট্রাভেল এজেন্সি থেকে বের হয়েছে।’

‘বর্ন সাইকোলজিস্ট’ দীপ্তির মতে, পুরুষ মানুষ প্রধানত: তিন ধরণের – হিরো, জিরো আর নিরো। হিরো টাইপের পুরুষরা মানুষের বিপদে আপদে সাহায্য করে। বিশেষ করে, কোন মেয়ে বিপদে পড়লে তো কথাই নেই, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে মেয়েটাকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করে।

জিরো টাইপের পুরুষরা কোন ধরণের ঝামেলায় জড়াবে না। নিজের কোন ধরণের ক্ষতি না করে যদি কাউকে টুকটাক সাহায্য করা যায়, করবে। এরা ‘জিরো লস্’ পলিসিতে বিশ্বাসী।

রোম যখন পুড়ছিল, নিরো নাকি তখন বেহালা বাজাচ্ছিল। এখান থেকে ‘নিরো টাইপ’ কথাটি নিয়েছে দীপ্তি। কেউ বিপদে পড়লে নিরো টাইপের পুরুষরা দূর থেকে তামাশা দেখে।

একটা ছোট উদাহরণ দিয়ে চৈতীকে তিন ধরনের পুরুষের পার্থক্য বুঝিয়েছে দীপ্তি। ধরা যাক, একটা মানুষ নদীতে পড়েছে, সাঁতার জানে না। হিরো টাইপের পুরুষরা তাকে বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। জিরো টাইপের পুরুষরা একটা লাঠি এগিয়ে দিতে চেষ্টা করবে, তবে খেয়াল রাখবে যাতে জুতায় কাদা লেগে না যায়। আর, নিরো টাইপের পুরুষরা নদীর পারে বেঞ্চে বসে ঝালমুড়ি খেতে খেতে ঘটনার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবে।

দীপ্তির সাথে যদিও হিমেলের পরিচয় ছিলো না, কিন্তু বড় বোনের কাছে তার সম্পর্কে বিস্তারিত শুনে ও বুঝতে পেরেছে, হিমেল হিরো টাইপের পুরুষ। যেহেত চৈতী-হিমেলের সম্পর্কটা আপনি-তুমিতে আটকে আছে, দীপ্তি প্রথমে চৈতীকে বলেছিলো, ‘সরাসরি বিয়ের কথা তোল।’ চৈতী তাতে রাজী হয়নি। দীপ্তি তখন বললো, ‘হিমেল ভাইয়াকে বলো বাবা তোমার বিয়ে ঠিক করেছেন।’ চৈতী সেটা বলেওছিলো। হিমেল উল্টো বুঝে এমন একটা উত্তর দিল যে, চৈতীর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।

সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে দীপ্তি মেলন ড্রপের পরিকল্পনা করেছে। চৈতীকে ও বলেছে, হিমেল ভাইয়ার হিম ভাবটা চৈতী হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে হবে।

মেলন ড্রপের কথা দীপ্তি শুনেছে চৈতীর কাছেই। এও শুনেছে, হিমেল ভাইয়া মেলন ড্রপসহ নানা কৌশলের এক্সপার্ট। তবে, মেলন ড্রপের এক্সপার্টকে মেলন ড্রপেই ঘায়েল করার বুদ্ধি দীপ্তির আছে।

চৈতীর জানা ছিল, হিমেল থাকে সিদ্ধেশ্বরী। চৈতীর এক বান্ধবী প্রায়ই শান্তিনগর মোড় থেকে হিমেলকে রিক্সা নিয়ে অফিসে যেতে দেখে। এ কারণেই মেলন ড্রপের জন্য শান্তিনগর মোড় ওরা বেছে নিয়েছে। পৌনে দশটায় হিমেলকে দেখা মাত্রই চুল ঠিক করতে শুরু করেছিল চৈতী, যাতে দীপ্তি বুঝতে পারে সময় হয়েছে।

দুদিন ইন্টারনেটে পড়ে আর চিন্তা-ভাবনা করে দীপ্তি মেলন ড্রপকে এক ধাপ সামনে নিয়ে গেছে, দাঁড় করিয়েছে একটা ডাবল লেয়ারের মেলন ড্রপ। আপাত: দৃষ্টিতে মনে হবে, এই মেলন ড্রপের ‘মেলন’ হলো ফুলদানীটা, আর টার্গেট হলো অভিজাত চেহারার সেই প্রৌঢ় লোকটি।

কিন্তু, এই মেলন ড্রপের আসল মেলন হলো চৈতী – একই সাথে সুন্দর সাজে সজ্জিত (যাতে হিমেল মুগ্ধ হয়), আর আপাত: দৃষ্টিতে আর্থিক-সংকটাপন্ন (যাতে হিমেলের হিরো ভাব জেগে ওঠে)।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এই মেলন ড্রপের আসল টার্গেট সেই প্রৌঢ় লোকটি নয়। আসল টার্গেট ছিলো এই গল্পের নায়ক, মেলন ড্রপের এক্সপার্ট, হিমেল নিজেই।

(শেষ)

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪

জাফর আহমেদ খান

প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪