দ্য মেক্সিকান স্ট্যান্ডঅফ
(১)
নাজিমের ঘুম ভাঙলো সকাল আটটায়। পাশের বেডরুমে কোন সাড়াশব্দ নেই। শান্তা নিশ্চয়ই এখনও ওঠেনি।
বছর দুয়েক আগে বিয়ে হয়েছে ওদের। তখন থেকেই শান্তার পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া আরামবাগের এই ফ্ল্যাটে থাকে ওরা। তবে, মাসখানেক ধরে ওদের মধ্যে সেপারেশন চলছে। ডিভোর্স শুধু সময়ের ব্যাপার।
বিয়ের পরও শান্তা নিয়মিত অন্য পুরুষদের সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছে। প্রথমদিকে নাজিম ভেবেছিলো, হয়তো ওর নিজের কোন ধরণের যৌন অক্ষমতা রয়েছে। পরে ও বুঝতে পেরেছে, শান্তা একটা নিম্ফোম্যানিয়াক – কারণ, দু’বছরে কমপক্ষে দশজন পুরুষের সাথে সে সম্পর্ক করেছে।
মাস ছয়েক হলো নাজিম নিজেও একটি মেয়ের সাথে জড়িয়েছে। মেয়েটির নাম ইলোরা, বয়স ঊনত্রিশ, নাজিমের চেয়ে বছর পাঁচেক ছোট। মতিঝিলে নাজিমের ইনডেন্টিং ফার্মে চাকুরি করে সে। সেগুনবাগিচায় থাকে।
বিছানা থেকে নামলো নাজিম। বাথরুমে ঢুকতেই অভ্যাসবশত ওর চোখ গেল কমোডের গায়ে COTTO ব্র্যান্ডের মনোগ্রামের দিকে। প্রথমদিকে ওর মনে হতো COTTO শব্দটির উচ্চারণ ‘কটো’। কিন্তু, শান্তার লাগামহীন ব্যাভিচারে নিজেকে যখন নাজিম যৌন ব্যাপারে অক্ষম ভাবতো, তখন ওর মনে হতো শব্দটির উচ্চারণ ‘ছোট্ট’। ইলোরার সাথে সম্পর্ক শুরু হওয়ার পর থেকে শব্দটির উচ্চারণ আবার ‘কটো’ মনে হচ্ছে।
নাজিমের সাথে ইলোরার সম্পর্ক আছে বুঝতে পেরে শান্তা ঝামেলা শুরু করেছে। কিছুদিন আগে নাজিমের অফিসে এসে ইলোরাকে সে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে। নাজিম বাধা দিতে চেষ্টা করায় ওকেও অপদস্থ করেছে।
শান্তা নিজে দশজনের সাথে সম্পর্ক করবে, কিন্তু নাজিম একজনের সাথেও সম্পর্ক করতে পারবে না!
সেদিনই প্রথম শান্তাকে খুন করার চিন্তা নাজিমের মাথায় আসে।
গত দু’বছরে শান্তার কারণে নাজিমের অনেক মানসিক ও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ডিভোর্সের আগে শান্তাকে খুন করলে সেই ক্ষতি পূরণ হবে। বছরখানেক আগে শান্তার বাবা মারা যাওয়ায় সে এই ফ্ল্যাটটিসহ প্রায় ছয় কোটি টাকার সম্পত্তি পেয়েছে। ওদের কোন সন্তান না থাকায় শান্তা মারা গেলে নাজিম পাবে ওর সম্পত্তির অর্ধেক, তার মানে প্রায় তিন কোটি টাকা। বাকী সম্পত্তি শান্তার মা আর একমাত্র ভাইয়ের মধ্যে ভাগ হবে।
গত দু’সপ্তাহ ধরে খুনের পরিকল্পনা করছে নাজিম। আজ রাতে সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হবে। পুলিশ যাতে ওকে সন্দেহ না করে, সেজন্য ইলোরার সাহায্য দরকার হবে। অনেক অনুরোধের পর মেয়েটি ওকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে। প্ল্যানটা এমনভাবে করা হয়েছে, নাজিম ধরা পড়লেও ইলোরার জড়িত থাকার কোন প্রমাণ পুলিশ পাবে না।
দাঁত ব্রাশ, শেভ আর গোসল শেষ করে বাথরুম থেকে বের হলো নাজিম। কাজের বুয়া নাস্তা খেতে ডাকলো। হাত নেড়ে না করে দিলো ও। টেনশনে খাওয়ার রুচি চলে গেছে, তাই ‘মেক্সিকান ব্রেকফাস্ট’ সারলো ও – এক গ্লাস পানি আর একটা সিগারেট।
খুনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইলোরার সাথে কথা বলার জন্য নাজিম দুটো কম দামি মোবাইল কিনেছে। দুটো সিমের কোনটাই ওর বা ইলোরার নামে রেজিস্ট্রেশন করা নয় – এ জন্য অনেক নগদ টাকা গুনতে হয়েছে।
নয়টা পঁচিশে ইলোরাকে কল করলো ও।
‘হ্যালো।’ ইলোরার মিষ্টি কণ্ঠ শোনা গেল।
‘সব ঠিক আছে? গাড়ি এসেছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে, রওয়ানা দাও। গুড লাক।’
‘গুড লাক, জানু।’
(২)
সকাল সাড়ে নয়টায় ভাড়া করা প্রাইভেট কারে ইলোরা ময়মনসিংহ রওয়ানা হলো। সাথে নিয়েছে একটা ট্রলি ব্যাগ আর একটা ছোট ব্যাকপ্যাক। ট্রলি ব্যাগে ওর আর নাজিমের ব্যবহারের কাপড়-চোপড়। ব্যাকপ্যাকে খুনের কাজে ব্যবহারের জন্য একবারে নতুন এক সেট প্যান্ট, জামা আর কেডস।
সোয়া বারোটায় ময়মনসিংহ শহরের টেকনিক্যাল মোড়ের কাছে ‘ভায়োলেট গেস্টহাউজ’-এ পৌঁছালো ইলোরা। ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি বিদায় করলো। দোতলায় একটা ডাবল ডিলাক্স রুম পছন্দ করলো সে। চেক-ইন করার সময় ওর আর নাজিমের আসল নাম ব্যবহার করলো, সম্পর্কের ঘরে লিখলো স্বামী-স্ত্রী।
এখন পর্যন্ত কোন মিথ্যার আশ্রয় ওকে নিতে হয়নি। সপ্তাহখানেক আগে মিরপুরের এক কাজি অফিসে ওরা বিয়ে করেছে। ওদের দু’জনের বাসা থেকে মিরপুর অনেক দূরে। তাই, ওরা না বলা পর্যন্ত কেউ এই বিয়ের খোঁজ পাবে না বলে নাজিমের ধারণা। বাড়তি সতর্কতার কারণে কাজির দেয়া কাগজপত্র নাজিম পুড়িয়ে ফেলেছে – ওর দ্বিতীয় বিয়ের কথা জানলে পুলিশ শান্তাকে খুন করার মোটিভ পেয়ে যাবে।
প্রয়োজন হলে ওরা এই বিয়ের কথা প্রকাশ করবে। কাজির কেতাবে ওদের বিয়ের তথ্য রয়েছে।
গেস্টহাউজের রুম থেকে একটা তোয়ালে, একটা গ্লাস, রাইটিং প্যাড আর কলম ব্যাকপ্যাকে নিলো ইলোরা।
বিকেল পৌনে চারটায় একটা ভাড়া করা প্রাইভেট কারে ইলোরা গাজীপুর চৌরাস্তা রওয়ানা হলো। ওর পরনে বাদামী প্যান্ট আর সাদা ফতুয়া। সাথে নিয়েছে ব্যাকপ্যাক আর নাজিমের দেয়া মোবাইলটি। ওর নিজের মোবাইলটি সাইলেন্ট করে গেস্টহাউজের রুমে রেখে এসেছে, যাতে মোবাইল ট্র্যাকিং-এ ওর গাজীপুর যাওয়াটা ধরা না পড়ে। তবে, ধরা পড়লেও ব্যাখ্যা তৈরি আছে।
এদিকে নাজিম বিকেল সোয়া চারটায় তার টয়োটা ফিল্ডার গাড়িতে ঢাকা থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা রওয়ানা হলো। ও নিজেই গাড়িটি চালাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই ড্রাইভারকে ছুটি দিয়েছে।
নাজিমের পরনে বাদামী প্যান্ট, সাদা হাফ শার্ট। মাথায় আকাশী ক্যাপ। দু’টো মোবাইলই সাথে নিয়েছে ও, তবে রেগুলার মোবাইলটি ফ্লাইট মোড-এ রেখেছে। ইলোরা ছাড়া আর কারও সাথে ও এখন কথা বলতে চায় না।
পাঁচটা বিশে গাজীপুর চৌরাস্তায় পৌঁছালো নাজিম। গাড়িটা একটা সাইড রোডে পার্ক করে পিছনের সিটে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো।
মিনিট দশেক পর ইলোরা গাজীপুর চৌরাস্তায় গাড়ি থেকে নামলো। ভাড়া মিটিয়ে কিছুটা পথ হেঁটে নাজিমের গাড়িতে উঠলো। দুজন হাত ধরাধরি করে বসে রইলো কিছুক্ষণ।
হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেল। নাজিম ভাবলো, মেঘ না চাইতেই জল! ইলোরাকে কাছে টেনে নিলো সে।
ইলোরা সাথে করে চিকেন ক্লাব স্যান্ডউইচ নিয়ে এসেছিলো। দু’জনে দুটো স্যান্ডউইচ খেলো।
ব্যাকপ্যাক থেকে শার্ট, প্যান্ট আর কেডস বের করে রাখলো নাজিম। গেস্টহাউজের গ্লাস, রাইটিং প্যাড আর কলম হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলো, যাতে এগুলোর গায়ে ওর হাতের ছাপ পড়ে। রাইটিং প্যাডে এলোমেলো কিছু কথা লিখলো, একজন লোক অলস বসে থাকলে যেমন লেখে। তোয়ালে দিয়ে শরীরের ঘাম মুছলো।
এ সবই করা হচ্ছে গেস্টহাউজের রুমে নাজিমের অবস্থান প্রমাণ করার জন্য। বাংলাদেশের পুলিশ এত সূক্ষ্ম তদন্ত সাধারণত করে না। কিন্তু, শান্তার মৃত্যু হলে ওর বড় ভাই শরিফ হয়তো অনেক চেষ্টা করবে নাজিমকে খুনি প্রমাণ করার জন্য। লোকটার টাকার অভাব নেই।
ড্রেস চেঞ্জ করলো নাজিম। নতুন শার্ট-প্যান্ট কালো রঙের, যা ও কখনও পরে না। নতুন কেডস বাদামী রঙের, যা ওর কেডসগুলোর থেকে আলাদা। খুনের সময় ওর পোশাক দেখে কেউ যেন চিনতে না পারে।
খুলে রাখা পোশাক আর জুতো গুছিয়ে গাড়িতেই রাখলো ইলোরা।
‘আমার কেমন অস্থির লাগছে,’ বললো সে। ‘যদি তুমি ধরা পড়ে যাও?’
‘সন্দেহভাজন হিসেবে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করতে পারে। তবে, প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে।’
‘যদি কোনও প্রমাণ পেয়ে যায়? তোমার তখন কী হবে? আমিই বা কী করবো?’
‘প্রত্যক্ষদর্শী না থাকলে ফাঁসি সাধারণত হয় না। বড় জোর যাবজ্জীবন। ভাল লইয়াররা আইনের অনেক ফাঁকফোকর বের করে ফেলে। সেক্ষেত্রে পাঁচ-সাত বছরের বেশি জেল নাও হতে পারে। একজন জাঁদরেল লইয়ার মনে মনে ঠিক করে রেখেছি। যদি পাঁচ বছরের বেশি জেল হয়ে যায়, আমার জন্য অপেক্ষা করো না।’
ইলোরা হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলো।
(৩)
সাড়ে ছয়টায় বৃষ্টি থামতেই দুজনে গাড়ি থেকে নামলো। ইলোরা চলে গেল ড্রাইভিং সিটে। নাজিমকে বিদায় জানিয়ে ময়মনসিংহের পথে রওয়ানা হলো সে। ওর মাথায় নাজিমের আকাশী ক্যাপটা, স্ট্র্যাপ টেনে একটু ছোট করে নেয়া হয়েছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ের সিসি ক্যামেরায় মনে হবে নাজিমই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে।
একটা রিকশা নিয়ে নির্দিষ্ট একটা গ্যারেজের দিকে চললো নাজিম। ওর রেগুলার মোবাইলটা ফ্লাইট মোড-এ গাড়িতেই রেখে দিয়েছে ও। ওর ধারণা, পুলিশ ঐ মোবাইলের আজকের গতিবিধি চেক করতে পারবে। ওর গাড়িতেও জিপিএস ট্র্যাকার রয়েছে, পুলিশ হয়তো চেক করতে পারবে গাড়িটা কখন কোথায় ছিলো।
এক সপ্তাহ আগে মিরপুরের একটা শোরুম থেকে নাজিম একটা ১৪৯ সিসি ইয়ামাহা মোটরসাইকেল কিনেছে। তারা ওর লাইসেন্সের কপি চেয়েছিলো। নাজিমের মোটর সাইকেলের লাইসেন্স নেই, থাকলেও ওদেরকে দেয়া যেতো না। ও বলেছে, কাগজপত্র আনা হয়নি, বাইকটা নিয়ে যাই, পরে কাগজপত্রসহ এসে রিসিট নিয়ে যাবো। নগদ টাকা পাওয়ায় তারা না করেনি।
বাইকের সাথে একটা হেলমেট ফ্রি পাওয়া গেছে। সেদিনই বাইকটা চালিয়ে এসে গাজীপুরের গ্যারেজটাতে রেখে গেছে ও। একজন মুদি দোকানদার তার মালপত্র রাখার জন্য গ্যারেজটা ব্যবহার করে। তাকে কিছু টাকা দিয়ে এক সপ্তাহের জন্য হেলমেটসহ বাইকটা রাখার ব্যবস্থা করেছে নাজিম। সেই সাথে রেখেছে তালা দেয়া একটা ছোট বাক্স, যার মধ্যে রয়েছে একটা নাইন এমএম পিস্তল। পশ্চিমবঙ্গের মালদা থেকে চাপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ হয়ে ঢাকায় এসেছে ম্যাগাজিনসহ পিস্তলটি।
বাইকে ট্যাংকভর্তি অকটেন নিয়ে সন্ধ্যা সাতটায় নাজিম ঢাকার পথে রওয়ানা হলো। নিরাপত্তা আর গোপনীয়তার স্বার্থে হেলমেট পরে আছে ও। পিস্তলটা ওর প্যান্টের পকেটে।
শেষের পথটুকু ধীরগতিতে চালিয়ে আটটা বিশে আরামবাগে পৌঁছালো নাজিম। বাসা থেকে একটু দূরে অন্ধকার একটা জায়গায় বাইক থামিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।
প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় কাছেই এক বান্ধবীর বাসায় যায় শান্তা। সাড়ে আটটায় এই পথ দিয়ে হেঁটে বাসায় ফেরে। মিনিট দশেক অপেক্ষা করতে হবে নাজিমকে।
সাড়ে আটটা বেজে গেছে। শান্তার দেখা নেই। প্রত্যেকটা মিনিট এক ঘণ্টার সমান মনে হচ্ছে।
অবশেষে দূর থেকে শান্তাকে আসতে দেখা গেল। বাইকে স্টার্ট দিলো নাজিম। শান্তা কাছে আসতেই বাইক থেকে নেমে পিস্তল হাতে এগিয়ে গেল তার দিকে, কাঁধে ঝোলানো হ্যান্ডব্যাগ ধরে টানাটানি শুরু করলো। শান্তা কোন বাধা দিচ্ছে না, কিন্তু দূর থেকে দেখলে মনে হবে হ্যান্ডব্যাগের দখল নিয়ে দুজনে লড়াই হচ্ছে। হঠাৎ করেই শান্তার বাম চোখে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করলো নাজিম। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো মেয়েটি, তবে তার আগেই হ্যান্ডব্যাগটা নাজিমের হাতে চলে এসেছে। দ্রুত বাইকে চড়ে এলাকা ছাড়লো ও। রওয়ানা হলো ময়মনসিংহের পথে।
পৌনে নয়টায় ইলোরার কল এলো। বাইক থামিয়ে কলটা ধরলো নাজিম।
‘খবর কী?’ জানতে চাইলো ইলোরা। কন্ঠে উদ্বেগ।
‘Done,’ সংক্ষেপে বললো নাজিম। ‘তোমার খবর কী?’
‘এইমাত্র এলাম। গাড়িটা পার্ক করেছি গেস্টহাউজের পিছনের রাস্তায়। তোমার মোবাইলের ফ্লাইট মোড অফ করেছি। গাড়ির চাবি আর এই মোবাইলটা গাড়ির ভিতরে রেখে দরজা লক করবো, এই তো?’
‘ব্যাকপ্যাক আর রুমের চাবি নিয়ে নিতে ভুলো না।’
‘ভুলিনি। আর তো কথা হওয়ার সুযোগ নেই আজ রাতে?’
‘না। তবে, আজ রাতে আর কিছু ঘটবে না। যা ঘটার কাল ঘটবে। তোমার অনেক খাটুনি গেছে। রুমে গিয়ে আরাম করে ঘুমাও।’
‘ও.কে.। বাই, জানু।’
‘বাই, জানু।’
(৪)
রাত পৌনে এগারোটায় ময়মনসিংহে পৌঁছালো নাজিম। ভায়োলেট গেস্টহাউজের পিছনে পার্ক করা গাড়িটি আনলক করলো স্পেয়ার-কি দিয়ে। প্রথমেই ওর রেগুলার মোবাইলের কললিস্ট চেক করলো। শান্তার বড় ভাই শরিফ কল করেছে সাতবার। প্রথম কলটি এসেছে সাড়ে নয়টায়। অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে এক মিনিটের ব্যবধানে দু’বার কল এসেছে সাড়ে দশটার দিকে। সম্ভবত পুলিশ।
পোশাক বদলে আগের পোশাক পরলো নাজিম, কেডস খুলে জুতো পরলো। গাড়িটা লক করে বাইক চালিয়ে কোয়ার্টার মাইল দূরে একটা পরিত্যক্ত পুকুরের কাছে পৌঁছালো। আশেপাশে কোন মানুষের চিহ্ন নেই।
বাইক, পিস্তল, শান্তার হ্যান্ডব্যাগ আর খুনের কাজে ব্যবহৃত পোশাক ঠাঁই পেলো পুকুরের তলদেশে।
পায়ে হেঁটে ফিরতি পথ ধরলো নাজিম। রাস্তার পাশে ময়লা কালো পানিভর্তি ড্রেনে ফেলে দিলো ওর আর ইলোরার মোবাইল দু’টো, সেই সাথে গাড়ির স্পেয়ার-কি। ঢাকায় ফেরার সাথে সাথে ওকে অ্যারেস্ট করা হতে পারে। ওর কাছে গাড়ির দুই সেট চাবি পেলে পুলিশ সন্দেহ করবে। স্পেয়ার-কি বাসায় না থেকে ওর সাথে থাকবে কেন?
এগারোটা পঁচিশে অপরিচিত নাম্বারটিতে কলব্যাক করলো নাজিম।
‘হ্যালো।’ গম্ভীর গলা।
‘এই নাম্বার থেকে আমাকে কল করা হয়েছিলো।’
‘নাজিম সাহেব বলছেন?’
‘হ্যাঁ ⋯ আপনি?’
‘আমি এস.আই. ফিরোজ বলছি। আপনি কোথায়?’
‘আমি তো ময়মনসিং। কেন, কী ব্যাপার?’
‘আপনার ওয়াইফের খবর জানেন?’
‘না তো! কী খবর?’
‘শি ইজ ডেড।’
‘মাই গড!’ একটু চুপ করে থেকে নাজিম জানতে চাইলো, ‘অ্যাক্সিডেন্ট?’
‘মাথায় গুলি খেয়েছেন। পিজিতে নেয়ার পর জানা গেল ডেড। আপনি এখনই ঢাকা চলে আসুন। মতিঝিল থানায় যোগাযোগ করুন।’
‘ও.কে.।’
রাত দুইটায় মতিঝিল থানায় রিপোর্ট করলো নাজিম। ওকে অ্যারেস্ট করা হলো না। এস.আই. ফিরোজ থানায় না থাকায় ওকে সকাল নয়টায় আবার যেতে বলা হলো।
বাসায় ফিরে মোবাইলে সকাল আটটার অ্যালার্ম সেট করে ঘুমিয়ে পড়লো ও।
সকাল নয়টার আগেই থানায় পৌঁছালো নাজিম। ওকে ওয়েটিং রুমে বসতে বলা হলো। ইলোরাকে কল করতে গিয়েও করলো না ও। ঘুম থেকে উঠলে মেয়েটা নিজেই ওকে কল করবে, এমনটাই বলা আছে। দশটার একটু পরে ওসি সাহেবের রুমে ওর ডাক পড়লো।
(৫)
ওসি আকমলের বয়স পঞ্চান্নের কাছাকাছি, মাথায় টাক। তার ডানদিকে বসে আছেন এস.আই. ফিরোজ। ওসি সাহেবের হাতের ইশারায় একটি চেয়ারে বসলো নাজিম।
কথা শুরু করলেন এস.আই. ফিরোজ। ‘নাজিম সাহেব, সরাসরি কাজের কথায় আসি। কেউ কেউ মনে করছেন, আপনার স্ত্রীকে আপনি খুন করেছেন –’
‘সেই কেউ-কেউটা নিশ্চয়ই শান্তার বড় ভাই শরিফ?’ নাজিমের কন্ঠে বিদ্রুপ। ‘সবাই জানে যে তিনি আমাকে দেখতে পারেন না।’
এস.আই. ফিরোজ শরিফের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেন। জানতে চাইলেন, ‘আপনি গতকাল বিকাল থেকে কোথায় ছিলেন?’
‘আমি গতকাল বিকেল সোয়া চারটায় আমার গাড়িতে ময়মনসিং রওয়ানা দিয়েছি। সাড়ে পাঁচটার দিকে ঘণ্টা খানেকের জন্য গাজীপুর চৌরাস্তায় থেমেছি। সাড়ে ছয়টায় আবার গাড়ি ছেড়ে নয়টার একটু আগে ময়মনসিং পৌঁছেছি।’
‘ময়মনসিং গিয়ে কোথায় উঠলেন?’
‘ভায়োলেট গেস্টহাউজে। টেকনিক্যাল মোড়ের কাছে।’
‘কত নম্বর রুমে?’
‘২০৩-এ।’
‘রুমে আপনার সাথে কেউ ছিলো?’
চুপ করে রইলো নাজিম। তারপর বললো, ‘এসব তো প্রাসঙ্গিক না।’
‘মার্ডার কেসে সবই প্রাসঙ্গিক। দয়া করে উত্তর দিন।’
তবুও চুপ করে রইলো নাজিম।
‘মিস ইলোরা?’ জানতে চাইলেন এস.আই. ফিরোজ।
নামটা যেহেতু এরা জেনেই ফেলেছে, চুপ থেকে লাভ নেই। ‘হ্যাঁ,’ বললো নাজিম।
‘ইলোরা কখন গিয়েছেন গেস্টহাউজে?’
‘দুপুরে।’
‘তিনি আর বের হননি?’
‘আমি শিওর না।’
‘আপনার সাথে তার দেখা হয়েছে রাত পৌনে নয়টায়?’
‘আর একটু পরে।’
‘নয়টার আগে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি ঢাকা রওয়ানা হলেন কখন?’
‘আপনার সাথে কথা শেষ করেই। বারোটার আগে।’
‘সাড়ে এগারোটার পরে?’
প্রশ্নটা শুনে একটু অবাক হলো নাজিম। অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করছে কেন লোকটা? ‘হ্যাঁ,’ বললো সে।
‘নয়টা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ইলোরার সাথেই ছিলেন?’
এস.আই. ফিরোজের গলার স্বরে কিছু একটা ছিলো, একটু দ্বিধায় পড়ে গেল নাজিম। ভায়োলেট গেস্টহাউজে সিসিটিভি সব সময় ‘নষ্ট’ থাকে, সে জন্যই এই গেস্টহাউজটি বেছে নিয়েছে ও। রাস্তায় সিসি ক্যামেরা নেই, এমন জায়গা বেছে নেয়া হয়েছে গাড়ি পার্ক করার জন্য। পুকুরে যাওয়ার পথে কোথাও কি সিসি ক্যামেরা আছে?
‘দু’একবার একটু বের হয়েছি।’ অপশন ওপেন রাখা ভালো, ভাবলো নাজিম।
‘কী জন্য?’
‘একটু হাঁটাহাঁটি করা – ’
‘দূরে কোথাও চলে যাননি?’
‘নাহ্।’
‘তার মানে, নয়টা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ইলোরার সাথেই ছিলেন, পাঁচ-দশ মিনিট ছাড়া?’
‘যদ্দূর মনে পড়ে।’
‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট, মিস্টার নাজিম। খুনের দায়ে আপনাকে গ্রেফতার করা হলো।’
‘মানে! পাঁচ-দশ মিনিটে ঢাকা চলে এসেছি? শান্তাকে খুন করে –’
‘আপনাকে অ্যারেস্ট করা হচ্ছে মিস ইলোরাকে খুন করার জন্য।’
(৬)
থানা হাজতে বসে ইলোরার কথা চিন্তা করছে নাজিম। মেয়েটা আর নেই, এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সবকিছু অর্থহীন মনে হচ্ছে।
পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, রাত নয়টা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে ইলোরা খুন হয়েছে। নয়টায় মেয়েটা একটা কফি অর্ডার দিয়েছিলো। সাড়ে এগারোটায় তার রুমের দরজা ফাঁক হয়ে আছে দেখে গেস্টহাউজের একজন কর্মচারী কলিংবেল বাজায়। সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা খুলে উঁকি মেরে দেখে মেঝেতে ইলোরার ছুরিবিদ্ধ লাশ পড়ে আছে।
ধর্ষণের কোন আলামত পাওয়া যায়নি। কোন টাকা পয়সা বা জিনিসপত্র খোয়া গেছে বলেও পুলিশের মনে হয়নি।
নাজিম ভাবলো, টাকা আসলেই কি খোয়া যায়নি? পার্সে চার হাজার টাকা থাকলে খুনি যদি তিন হাজার টাকা নিয়ে যায়, পুলিশ বুঝবে কীভাবে? কর্মচারীটা কতটুকু বিশ্বস্ত?
নিজের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলো নাজিম। যদি ইলোরা হত্যায় ওকে অভিযুক্ত করা হয়, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা বেশ কঠিন হবে। ও যদি বলে গেস্টহাউজে ছিলো না, তাহলে প্রশ্ন উঠবে কোথায় ছিলো?
তবে, কেউ মনে করবে না ইলোরাকে ও প্ল্যান করে খুন করেছে। ইলোরার সাথে ওর বিয়ের তথ্যটা এখানে কাজে লাগবে – বিয়ের মাত্র এক সপ্তাহ পরে কেউ বউকে খুনের প্ল্যান করে না (ইলোরার উল্লেখযোগ্য কোন সম্পত্তি নেই)। সবাই মনে করবে, রাগের মাথায় ও মেয়েটাকে মেরে ফেলেছে। দোষী সাব্যস্ত হলে নাজিমের শাস্তি হবে পাঁচ-সাত বছরের জেল।
শান্তার খুনি প্রমাণ হলে নাজিমের শাস্তি বেশি হবে। প্ল্যান করে খুনের শাস্তি কমপক্ষে যাবজ্জীবন। শান্তার কোন সম্পত্তিও নাজিম পাবে না। আইন অনুযায়ী, খুন করে কারও সম্পত্তির অংশ পাওয়া যায় না।
হঠাৎ করে হাজতের বাইরে শরিফকে দেখা গেল। নাজিমের দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সে।
‘তুই আমার বোনকে খুন করেছিস,’ আঙ্গুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে বললো শরিফ।
মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, ভাবলো নাজিম। বললো, ‘পুলিশ বলছে, আমি ইলোরাকে মেরেছি। আপনি বলছেন শান্তাকে মেরেছি। দুই শহরে দু’জনকে আমি একই সঙ্গে কীভাবে মারলাম?’
‘ইলোরার কথা জানি না। শান্তাকে তুই মেরেছিস আমি শিওর।’
‘কীভাবে এত শিওর হলেন? কল্পনাশক্তি?’
‘কল্পনা না। আমার কাছে প্রমাণ আছে।’
শরিফের কথাটা ভাঁওতা মনে হচ্ছে না। কিন্তু, পুলিশ এখনও যা জানে না, শরিফ কীভাবে জানে?
নাজিম হঠাৎ বুঝতে পারলো, শরিফ ইলোরা হত্যায় জড়িত। খুনি ইলোরার গতিবিধি খেয়াল করেছে। খুনির পক্ষেই জানা সম্ভব নাজিম গেস্টহাউজে যায়নি।
‘তুই কী ভেবেছিস?’ শরিফ আবার বললো। ‘আমার বোনকে খুন করে তার তিন কোটি টাকা ভোগ করবি? এক হিসেবে টাকাটা আমার। আমি এমনিতেই ছেড়ে দিবো?’
‘আমি শান্তাকে মেরেছি, এটা প্রমাণ করা তো খুব সোজা। আপনি পুলিশের কাছে সত্যি কথা বলে ফেলুন। বলুন যে ইলোরাকে আপনি খুন করেছেন।’
‘আমি কীভাবে খুন করলাম? গতকাল রাতে পিজি হাসপাতালে সবাই আমাকে দেখেছে।’
‘হতে পারে। কিন্তু, আপনার কুকর্মের সহযোগী বারেক কোথায় ছিলো?’
নাজিমের কথাটা জায়গামত গিয়ে আঘাত করলো। শরিফ একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ‘দেখা যাক কে কী প্রমাণ করতে পারে।’
চলে গেল শরিফ। নাজিম বুঝতে পারলো, পরিস্থিতি বেশ জটিল। ওর কাছে যেমন শরিফকে ঘায়েল করার তথ্য আছে, তেমনি শরিফের কাছেও ওকে ঘায়েল করার তথ্য আছে।
নাজিম জানে, শরিফ ইলোরাকে খুন করিয়েছে। নাজিম যদি তথ্যটা কাজে লাগাতে পারে, শরিফের যাবজ্জীবন হবে। কিন্তু, নাজিম যে শান্তার খুনি, এটা প্রকাশ হয়ে পড়বে – ওরও যাবজ্জীবন হবে এবং তিন কোটি টাকা হাতছাড়া হবে। নাজিম যদি তথ্যটা গোপন রাখে, ইলোরা হত্যার দায় ওর উপর পড়বে – তবে, মাত্র পাঁচ-সাত বছরের জেল হবে এবং তিন কোটি টাকা পাবে। কিন্তু, শরিফ ইলোরাকে খুন করেও পার পেয়ে যাবে।
এদিকে শরিফ জানে, নাজিম শান্তাকে খুন করেছে। শরিফ যদি এটা প্রমাণ করতে যায়, সে যে ইলোরার খুনি, এটা প্রকাশ হয়ে পড়বে। সে যদি চুপ থাকে, তাহলে শাস্তির হাত থেকে বেঁচে যাবে, কিন্তু তিন কোটি টাকা লস হবে।
নাজিমের হঠাৎ মনে হলো, ওর আর শরিফের অবস্থাটা যেন একটা মেক্সিকান স্ট্যান্ডঅফ – যেখানে দু’জন লোক একে অন্যের দিকে বন্দুক তাক করে আছে। দু’জনের কারোই নিশ্চিত জয়ের কোন কৌশল নেই। একজন অন্যজনকে গুলি করতে গেলে নিজেও গুলি খাবে। আবার, পিছিয়ে যাবার জন্য নড়ে উঠলেও গুলি খেতে পারে। একমাত্র তৃতীয় কারও ভূমিকায় এই অচলাবস্থা কাটতে পারে।
নাজিম ভাবলো, ওর আর শরিফের এই স্ট্যান্ডঅফে আপাতত কালক্ষেপণই সেরা কৌশল।
(শেষ)
প্রাক্তন শিক্ষার্থী
পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪