fbpx

যদি সে পাখি হতো!

যদি সে পাখি হতো!

গতকাল পূর্ণিমা ছিলো। তবে রাতের আকাশটা ছিলো মেঘলা। ঘন কালো মেঘ নয়। সাদা মেঘ। শরতের মতো স্তূপ স্তূপ সাদা মেঘ। সাদা মেঘের মাঝে চাঁদ লুকোচুরি খেলছিলো। মেঘের আড়াল থেকে হঠাৎ হঠাৎ তার হাসিমাখা মুখ দেখা যেত। ঠিক যেমন পাঁচ-সাত মাসের নবজাতক তার বাবা-মায়ের সাথে লুকোচুরি খেলে।
এখন ভোর। সূর্য উঠতে মোটামুটি পৌনে এক ঘণ্টা বাকি। আকাশ অনেকটা পরিষ্কার। পূর্বাকাশে লাল আভা দেখা যাচ্ছে। অপরদিকে চাঁদ পশ্চিম আকাশে হাবুডুবু খাচ্ছে। এখন তাকে চলে যেতে হবে। যদিও বা সারা রাত হাজারো প্রেমিক তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল, কত মা তার শিশুদেরকে ‘চাঁদ মামা’ শুনিয়েছে, দালানের শত ছাদ থেকে কত কত কবিতা পৌঁছানো হয়েছে চাঁদের কাছে। কিন্তু তার এই বিদায়বেলায় কোথাও কেউ নেই। এ সময় দালানের প্রতিটা ছাদ ফাঁকা। প্রতিটা বললে ভুল হবে। একটা ছাদে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা বই। গল্পের বই। পাশেই একটা কেদারা রাখা। বেতের কেদারা। গল্লা বেতের তৈরি। আকাশের তরে দৃষ্টি রেখে, এক বেনামী চিঠি বাতাসে উড়িয়ে দিচ্ছে। ওষ্ঠের কলমে লেখা চিঠি রজনীকান্তের নিকট প্রেরণ করছে-
“ওহে রজনীকান্ত! চলে যাবে বুঝি? যাও। তবে যাবার আগে আমার কিছু না বলা কথা শুনে যাও। কথাগুলো রাতে বলার ইচ্ছে কিংবা সাহস কোনটাই ছিল না। তোমার অতো অতো প্রেমিকদের প্রণয়বাণীর মাঝে আমার এই চিঠি, তোমার নিকট হয়তো শুকনো নিমপাতার মতোই তুচ্ছ মনে হতো। তাই প্রেম নিবেদনের জন্য আমি এই বিমল বাতাস, উজ্জ্বল আকাশ, নিরলা সকালকেই বেঁছে নিলাম। ওহে রজনীকান্ত! আমার যৌবনের প্রথম যে পূর্ণিমায় তোমার দেখা পেয়েছি, সে রাতেই আমি প্রেমে পড়েছি। কী অপরূপ তুমি, প্রেমময়ী, নয়ন জুড়ানো তোমার হাসি! ভালোবাসি তোমায়। ভালোবাসি রজনীকান্ত!” এতটুকু বলেই সে তার দৃষ্টি নিম্নগামী করলো। এরপর এক দীর্ঘশ্বাস নিল। আবার বলা শুরু করলো,
“ভালোবাসি তোমায়। তাই তোমার রূপ-গুণের প্রশংসা করা যেমন আমার কর্তব্য; তেমনি তোমার ভুলগুলো একান্তে তোমায় ধরিয়ে দিয়ে ভুলগুলোকে ফুলে রূপান্তর করাও আমার কর্তব্য। ভালোবেসে যদি ভুল মুছে দিতে ভয় হয়, তবে সেটা ভালোবাসা নয়। হয়তো মোহ, নয়তো ধোঁকা। শুনো রজনীকান্ত, নিশ্চয়ই তোমার আগমন উজ্জ্বল, উল্লাসপূর্ণ, মনোমুগ্ধকর। তোমার জীবন-যৌবনও উজ্জ্বল। সকলকে মুগ্ধ করার মতো। কিন্তু তোমার অন্তিমকাল? কেমন যেন ধূসর,অবহেলিত। আচ্ছা, কখনো কি সূর্যকে লক্ষ করেছো? তার আগমনও কিন্তু মুগ্ধকর এবং কল্যাণকর। তার জীবন-যৌবন উদ্দীপ্ত, পৃথিবীর বুকে শান্তি এবং শক্তির জোয়ারের কারণ, সজীবতার কারণ, শৃঙ্খলতার কারণ। তাকে কেউ স্পর্শ করতে পারে না। তার দিকে কেউ চোখ তুলেও তাকাতে পারে না। মনে হয় সে যেন এক অসাধারণ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মহাজাগতিক বস্তু। তার বিদায়কাল যে ধূসর, তাও নয়; বরং সে দৃশ্যও মুগ্ধকর! পাথার পাড়ে কত কত পর্যটকের ভিড়, তাকে বিদায় জানানোর জন্য। তাই বলি, যদি পারো, পরের জন্মে সূর্যের মতো হইও। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো।” হামিদা চাঁদকে বিদায় জানিয়ে এভাবে চাঁদের প্রতি তার চিঠির ইতি টানলো।
হামিদার বয়স পঁচিশের কাছাকাছি হবে। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেছে। বছর খানেক হলো তার বিয়ে হয়েছে। শুরুতে এ বিয়েতে সে রাজি ছিল না। তার ইচ্ছে ছিল আরও কয়েক বছর পর বিয়ে করা। পাত্রের কোনো দোষ নাই। ছেলে গ্রামের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষায় অন্যদের থেকে এগিয়ে। দেরিতে বিয়ে করতে চাওয়ার পিছনে হামিদার অন্য কারণ ছিল। যদিও বা শেষ পর্যন্ত সেই কারণ, কোনো কারণ-অকারণে শুন্যে মিশে যায়। এরপর থেকে হামিদার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু।
হামিদার শ্বশুরবাড়ি কেশবপুর গ্রামে। স্বামীর নাম রবিন। বিসিএস ক্যাডার। পাশের জেলার ডিসি। বাড়িতে হামিদা, হামিদার শ্বশুর-শাশুড়ী আর ননদ থাকে। এই ভোর বেলায় তারা কেউ জেগে নেই। একমাত্র হামিদাই জাগ্রত। ভোরে জাগা আর বই পড়া হামিদার কলেজ জীবনের অভ্যাস। সে প্রতিদিন ভোরে একটা বই, বেতের কেদারা, আর ফ্লাক্সে করে কিছু পরিমাণ দুধ চা নিয়ে ছাদে চলে আসে। নিয়মমাফিক আজও এসেছে।
ফ্লাক্স থেকে আধ কাপের থেকে একটু বেশি চা নিয়ে কেদারায় বসে পড়লো। চায়ের কাপে ফু দিচ্ছে। চা এখনও অনেকটা গরম। ফু-এর সাথে সাথে চায়ের কাপ থেকে এক অসাধারণ ঘ্রাণসহ ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে। হামিদা শূন্যের মাঝে ধোঁয়ার পদাঙ্ক লক্ষ করছে। ধোঁয়াগুলো দিঘির উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। দিঘির ওপারে ধোঁয়াকে আর দেখা যাচ্ছে না। হালকা কুয়াশার সাথে মিশে গেছে। হামিদার দৃষ্টি এবার দিঘিতে। আর ঠোঁট চায়ের কাপেতে। দিঘির পানি কিছুটা অস্বচ্ছ। কিন্তু সেই অস্বচ্ছ পানিতে হাজারো কচুরিপানা ফুল মাথা জাগিয়ে ভাসছে। কী অপরূপ সেই ফুল! কী অপরূপ তাদের মাথা দোলানো! ফুলগুলোর সাদা পাঁপড়ির মাঝে বেগুনি ছোপযুক্ত, মাঝখানে হলুদ ফোঁটা। সাদা পাঁপড়ির স্থলে কোনটাতে আবার আকাশি পাঁপড়ি। সাদা বেগুনি বুকে নিয়ে ভাসছে হাজারো কচুরিপানা। অস্বচ্ছ দিঘির জলে এ যেন এক অপরূপ আল্পনা। কচুরিপানা ফুল যেন বাংলার এক অবহেলিত সৌন্দর্য!

হাজারো ফুলের ভিড়ে, হামিদার দৃষ্টি দুটো ফুলে আটকে আছে। ফুল দুটো অন্যদের থেকে আলাদা। রং কিছুটা গোলাপি। দুটো ফুল দু’স্থানে। তবে দুটোর আশে পাশে কিছুটা জায়গা জুড়ে শূন্য, কোনো কচুরিপানা নাই, কেবল দিঘির জল দেখা যাচ্ছে। সেই জল থেকে ছোট ছোট কিছু কৈ, পুঁটি, শিং এর পোনা প্রভাতের আলো নিজেদের গায়ে মাখার জন্য কিছুক্ষণ পরপর পানিচ্যুত হচ্ছে। এসব দৃশ্য হামিদা প্রতিনিয়তই দেখে। তবু দেখতে তার ভালো লাগে। হামিদা পরের দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় আছে। কিছুক্ষণ পর একঝাঁক অতিথি পাখি আসবে। ঝাঁক থেকে একটা পাখি দিঘির পাড়ে কড়ই গাছের ডালে এসে বসবে। অতিথি পাখিটি ডাল থেকে উড়ে গিয়ে দিঘির পানিতে ডুব দিবে। কোনো একটা ছোট মাছ ধরে হামিদার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাবে। কিন্তু গতকাল একটু ব্যতিক্রম হয়েছিল। অতিথি পাখিটি উড়ে যাবার সময় গোলাপি রঙের একটি ফুলের প্রায় দুটো পাঁপড়ি নিজের পাখা দিয়ে নষ্ট করে উড়ে গেছে। ফুল দুটোর জন্য হামিদার কিছুটা খারাপ লাগছিল। কারণ গোলাপি রঙের ফুলগুলো ঠিক যেন তাঁর জীবনের প্রতিচ্ছবি।
দিঘিতে মোট তিনটা গোলাপি রঙের ফুল ছিল। একটি ছিল একেবারে তীরের কাছে। গত পরশু দিঘির পথ ধরে আসার সময় হামিদা তার পছন্দের ফুলকে তুলে নিয়ে নিজেই নিজের খোঁপায় গুজে দিয়েছে। ইচ্ছে হয়েছিল বাকি দুটো ফুলও নিজের মতো করে নিজের কাছে রাখা। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। ফুল দুটো হামিদার হাতের নাগালের বাইরে ছিল। তবে চাইলেই সে ফুল তুলে আনতে পারতো, কারণ সাঁতার দেবার ক্ষমতা তার আছে। কিন্তু দিঘির ময়লা পানিতে সাঁতার দিয়ে ফুল তুলে, সেই ফুল খোঁপায় গোজার মতো বোকামি হামিদা করবে না। তাই ও দুটোকে নিজে না তুলে, অতিথি পাখির অপেক্ষায় ছিল। প্রতিদিন সে চাইতো, অতিথি পাখি তার জন্য ফুল দুটো মুখে করে এনে তাঁর খোঁপায় গুজে দিক। কিন্তু অতিথি তো অতিথিই। সে মাছ খেয়ে চলে যায়। হামিদা আজ অতিথির উপর কিছুটা রেগে আছে। তবু অপেক্ষা করে যদি সে আসে, যদি সে খোঁপায় ফুল গুজে দেয়।
চা-টুকু শেষ। কিন্তু আজ এখনো অতিথি পাখি আসে নি। হামিদা বইটা বের করে নতুন একটা গল্প পড়া শুরু করলো। আর অতিথি পাখির আশা ছাড়লো না। মেয়েরা এমনই। বারবার ফিরে তাকানো, বারবার আশা করা যেন তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য। যাইহোক, গল্পের নাম- “কোনো এক শীতের রাতে”।

– শীতের রাত। গ্রামের লোকজন আটটা-নয়টার মধ্যেই চায়ের দোকান, বাজার কিংবা যেকোনো মজলিশ শেষ করে ঘরে ফিরে। যদিও বা শীত কিংবা গরম সব ঋতুতেই গ্রামের লোকজন দ্রুতই ঘরে ফিরে। পরিবারের সাথে কিছুটা খুনসুটি করে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়। আজ বোধ হয় কুয়াশা একটু বেশি। কিন্তু নেয়ামুল এখনো ঘরে ফিরে নি। যাবার সময় কোনো মতে গায়ে একটা হুডি পড়ে হাতে করে নানুর চাদরটা নিয়ে গেছে। তাতে কি শীত মানবে? চাদরটাও নিতে চায় নি। ওর নানু জোড় করে দিয়ে দিয়েছে। নানুকে খুব ভালোবাসে, তাই না করতে পারে নি। নানুও নিউটনের তৃতীয় সূত্রের ব্যতিক্রম করে নি। নেয়ামুলের জন্য তার অঢেল ভালোবাসা। ছেলেটা এখনো ফিরে নি বলে, চিন্তায় সে অস্থির। রান্নাঘর থেকে একটা রসুন এনে তিনটা টুকরো করলো। আতিক, সিহাব আর তুষরকে ডেকে ওদের হাতে দিয়ে বললো, “এইগুলা পকেটে ভর। আর টেবিলের উপর থেকে টর্চটা খুলে নিয়ে বাজারের দিকে আগা। দেখ নেয়ামুল কদ্দুর আইছে। ফোনে চার্জ আছে না নাই কি জানি!” ওরা তিনজন খুবই আনন্দিত। এতক্ষণ বসে বসে ছোট ভাই-বোনদের ক,খ পড়াতে হচ্ছিলো। আতিক বসে বসে ফোন চালাচ্ছিল। ও এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চান্স পেয়েছে। গণিত বিভাগে। তাই এখন একটু ফ্রি। এডমিশনের সময় যে ঝড়টাই না গেছে ওর উপর দিয়ে! এখন নিজেরও পড়া নেই, অন্যকেও পড়াতে হয় না। সিহাব, তুষর একটু ভোগান্তিতে আছে। দুজনেই উচ্চমাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত আছে। যাইহোক ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে নামতেই পিছন থেকে নানুর ডাক। “আতিক, ও, আতিক! দাঁড়া। এই নে লগে কইরা হেরিকেনডাও নিয়ে যা। আর এই তিনডা লোয়ার(লোহার) টুকরাও লগে নিয়া যা। রসুন থাইকলে সমেস্যা হওয়ার কতা না। তাও রাত বিয়াল কওয়া যায় না। লগে আগুন, লোয়া থাহা ভালো।” ওরা তিনজন বেরিয়ে পড়লো। কথা বলতে বলতে প্রায় বাজারের কাছে পৌঁছে গেল। সামনে থেকে একটা আলো টিপ টিপ করে ওদের দিকে আগাচ্ছে। চাঁদনি রাত, তবে কুয়াশার কারণ বিশ ত্রিশ ফিটের সার্কেল সীমানার বাইরে কিছু দেখা যায় না। তুষর গলা ঝেড়ে উচ্চ আওয়াজে বললো, “কে? নেয়ামুল ভাই?” কোনো প্রতিউত্তর নেই। সিহাব কিছুটা ভয় পেলো। নানুর কাছে সে অনেক জ্বীন, ভূতের কিচ্ছা-কাহিনি শুনেছে। তবে আতিক, তুষর অতো পায় না। আতিক কিছুটা সামনে গিয়ে বলে, “আরে, ওটা নেয়ামুল ভাই হবে। দেখোস না গায়ে নানুর চাদরটা এখনো আছে?”
নেয়ামুল ওদেরকে সামনে দেখেই চমকে গেল।
– কিরে তোরা কোথায় যাচ্ছিস? আমায় খুঁজতে নাকি এগিয়ে নিয়ে যেতে?
সিহাব বললো, “হুম। নানু পাঠাইছে, তোমাকে আগাইয়া নিয়া যাইতে।”
– ওহ চল তাহলে!
– তোমাকে তুষর ডাকলো তাও সারা দেও নি কেন?
– আরে আমি কানে ইয়ারফোন দিয়ে তিলাওয়াত শুনছিলাম। শীতের কুয়াশাময় রাত, সাথে চাঁদের আলো। ভাবলাম এর সাথে আবদুর রহমান মাসুদের তিলয়াত শুনলে বেশ ভালো লাগবে। তাই তুষরের ডাক লক্ষ্য করি নি।
– ওহ, আচ্ছা।
আতিক বললো, “ভাই, খেঁজুরের রস খাবা? সামনেই আমাদের খেঁজুর গাছ আছে। ছয়টা হাঁড়ি ঝুলানো আছে। চলো আমরা একটা নামাই।”
“হাড়ির ভিতর তো পোকা থাকে, বাদুর মুখ দেয়, পাখিতে ঠোঁট দেয়। কাঁচা খাওয়া তো ঠিক না। “
সিহাব বললো, “ভাই তুমি কাঁচা রস খাবার মজাই বুঝো না। পোকা তো ছেঁকে ফেলা দুই মিনিটের ব্যাপার। আর দু এক হাঁড়ি রস খাইলে বাদুর-টাদুরের মুখ দেওয়া না দেওয়াতে কিছু হয় না।” “চল তাহলে। তুষর তো হাঁড়ি নামাতে ওস্তাদ। তুইই নামাবি। আর সিহাব গিয়ে কাঁচা ধানের কয়েকটা শিষ কেটে নিয়ে আসি। স্ট্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।”
পরিকল্পনামতো তুষর রসের হাঁড়ি নামিয়ে আনলো। এখন কোথায় বসে আরামে খাওয়া যাবে, সে ফিকির চলছে। বাড়িতে তো নেওয়াই যাবে না। এদিকে বসেই খেয়ে যেতে হবে। সিহাব বললো, “ভাই, সামনে জমিনে আমরা খইল্লান (ধান শুকানোর স্থান) বানাইছি। ওখানে বসে আরামছে খাওয়া যাবে।” সিহাবের কথা মতো ওরা সেখানে গিয়ে খড়ের একটা স্তূপের উপর সবাই গোল হয়ে বসলো। মাঝখানে রসের হাঁড়ি। রস মোটামুটি বিশুদ্ধ করার যা কাজ, তা আতিক করে ফেলছে। সিদ্ধান্ত হলো শুরুতে নেয়ামুল খাবে। নেয়ামুল ধানের কাঁচা শিষটা হাঁড়ির মুখের ভিতর দিয়ে একটানে প্রায় অর্ধেকের মতো রস খেয়ে ফেললো। আতিক বললো, “ভাই, তখন তো বললা পোকা, জীবাণু, হ্যান ত্যান। এখন তো একাই প্রায় অর্ধেক খেয়ে ফেললা।”
তুষর বললো, “কাঁচা রসের স্বাদ তো,নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে নি।” “নে, এবার তোরা খা।” ওরা তিনজন বাকিটুকু কাড়াকাড়ি করে খেয়ে ফেললো। এবার যাবার পালা। কিন্তু নেয়ামুলে মাথা একটু ঝিমঝিম করছে। নেয়ামুল বললো, “নে, একটু বসি। তারপর যাই। আর আমার বসার জায়গাটা বেশ গরম হয়ে গেছে। শীতের সময় খড়ের উপর বসলে আর উঠতে মন চায় না। খড়ের ওম অসাধারণ।” আতিক বললো, “বুঝছি, মাথা ঘুড়ে তো তাই! যাইহোক শুধু বসে না থেকে তিলাওয়াত শুনি। তুমি যেটা শুনছিলে সেটা চালু করো।” নেয়ামুল সূরা আল হাদীদ শুনছিলো। প্রথম পাঁচ আয়াত শুনছে। এখন ষষ্ঠ আয়াত থেকে চলা শুরু হচ্ছে: “তিনি রাতকে দিনের ভেতর প্রবেশ করান এবং দিনকে প্রবেশ করান রাতের ভেতর এবং মনের মধ্যকার সবকিছু সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত।”
চাঁদের জোৎস্না, রাতের কুয়াশা, খড়ের ওম, কাঁচা রসের স্বাদ আর সুমধুর সুরের তিলাওয়াতে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেছে। সূরা হাদীদ-এর তিলাওয়াত শেষ হতেই তুষর বললো, “নেয়ামুল ভাই, একটা প্রশ্ন ছিল। এখন বলবো, নাকি কাল?”
– কী প্রশ্ন? বলে ফেল। সমস্যা নাই।
– ‘ভাগ্য’ বিষয়টাকে তুমি কিভাবে দেখো।
– ‘ভাগ্য’একটা ইন্টারেস্টিং বিষয়। এটাকে অনেকভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়। তবে তোদের আমি একটু ভিন্ন ভাবে বলি। আমি যেভাবে ভেবেছি আরকি!
ওরা তিনজনই খুবই আগ্রহের দৃষ্টিতে নেয়ামুলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
– শোন, ভাগ্যের ইংরেজি কী? Luck, তাই তো?
– হুম (সিহাব)।
– আমার মতে, L for Labour, U for Use (of proper time), C for Character, K for Kindness (of God)। ভাগ্য হলো একটা চারতলা দালানের মতো। যার সবচেয়ে উপরের তলা হলো: ‘পরিশ্রম’। তার নিচের তলা ‘সময়ের সঠিক ব্যবহার’। তার পরের তলা ‘চরিত্র’। একেবারে নিচ তলা হলো ‘সৃষ্টিকর্তার দয়া’।
যে যেমন পরিশ্রম করবে তার ভাগ্য সেভাবে গড়বে। শুধু পরিশ্রম করলেই হবে না। সময়ের সঠিক ব্যবহার করে পরিশ্রম করতে হবে। যাকে বলে, Smart work is more effective than hard work। দালানের দ্বিতীয় তলাটি হলো: চরিত্র। চরিত্র মানে আচার-অভ্যাস। কারও আচার-অভ্যাস ভালো না হলেও সে সঠিক সময়ে পরিশ্রম করেও জীবনে আগাতে পারে না। আচার অভ্যাসের কারণে কত সফল ব্যাক্তির অসফল জীবনের ইতিহাস, ইতিহাসের পাতায় ছাপা হয়ে আছে। আর দালানের ভিত্তি হলো: সৃষ্টিকর্তার দয়া। কারো যদি পরিশ্রম, সময়ের সঠিক ব্যবহার,চরিত্র ঠিক থাকে তবে খুবই সম্ভাবনা আছে যে তার উপর রবের দয়া থাকবে, আর তার প্রত্যাশিত স্বপ্ন পূরণ হবে। যদি না হয় তবে বুঝে নিতে হবে, ঐ স্বপ্নে তার জন্য মঙ্গলময় কিছু নেই। (যদিও বা তার চোখে তার প্রত্যাশিত সেই ‘স্বপ্ন’ মঙ্গলময় মনে হলেও, তা কেবলই নিছক। কেননা ঐ চোখ তো তার বর্তমানকেই দেখতে পায় না, কেবল অতীত দেখতে সক্ষম। সেখানে ভবিষ্যত তো রহস্যময়)। কিংবা তার জীবনের অন্য কোনো মন্দ কর্মের প্রভাবে তার উপর থেকে রবের দয়া দূরে সরে গেছে। আবার কারো কারো উপরের তিন তলা না থাকলেও নিচ তলার সুবাদে তার স্বপ্ন পূরণ হয়। যদি তার জীবনের অন্য কোনো ভালো কর্মের প্রভাবে তার উপর রবের দয়া প্রকাশ পায়। যেমন: আমি তো শুরুর দিকে বুয়েটের জন্য খুবই আফসোস করতাম। আবার ঢাবির সিএসইর জন্যও আফসোস করতাম। কিন্তু আমি এখন বুঝতেছি। আমার জন্য ঢাবির পরিসংখ্যানই বেস্ট। সম্ভাবত হযরত ওমর (রাঃ) এরকম বলছেন যে, “মানুষের সামনে যদি তার তাকদির উপস্থাপন করা হতো, তাহলে সে ঠিক সেটাই পছন্দ করতো যা আল্লাহ সুবহানা তায়ালা তার জন্য ইতিমধ্যেই পছন্দ করে রেখেছেন।”
আতিক বললো, ভাই এই রিলেটেড আর একটা ছোট জিজ্ঞাসা আছে।
– তুমি বলে বেড়াও তুমি নিজে কখনো ডিপ্রেশনে পড়ো নি। বরং শহুরে মানুষের মুখে শুনতে শুনতেই এই অদ্ভুত শব্দটার সাথে পরিচিত হয়েছো। কিন্তু জীবনে তো অনেক ধরনের পরিস্থিতি আসে। তুমি নিজেকে কিভাবে সামলাও?
– একেবারে সিম্পল। প্রথমে দেখি, আমার দ্বারা যে পাপ বা ভুল বা ত্রুটিটা হয়েছে; সেটার জন্য আসলেই কি আমি দোষী? যদি ভেবে দেখি আমি দোষী না তবে আলহামদুলিল্লাহ। আর যদি দেখি আমার দোষ আছে তবে প্রথমে রবের কাছে ক্ষমা চাই। তারপর যদি সম্ভব হয় দোষটার কাফফারা আদায় করি। এবং ভবিষ্যতে চলার জন্য ছোট একটা প্ল্যান করি (গোল হিসেবে ঠিক করি জান্নাত+দুনিয়াতে সুখী হওয়া যতটা সম্ভব)। আর মনকে বলি, যেটা হয়েছে সেটা নিয়ে না ভেবে সামনে যাতে ভালো হয় সেটা নিয়া ভাবতে। আমি খুবই লজিক্যাল। তাই ব্রেইনকে যা বলি বুঝে নেয়। আর অধিকাংশ সিদ্ধান্ত অনেকের সাথে পরামর্শ করে ভেবে তারপর নিজের মন-মস্তিষ্ক যেটা বলে সেটা করি। নিজেদের মন-মস্তিষ্কের সামনে আমরা প্রত্যেকেই একেবারে আয়নার মতো স্পষ্ট। নিজের বিবেককে ধোঁকা দেওয়া যায় না।
– বাহ, জোস তো! আচ্ছা ভাইয়া, তোমার সাথে যখন কেউ ভালো ব্যবহার করে বা যখন কেউ খারাপ ব্যবহার করে তখন তোমার কেমন অনুভূতি হয়?
– আমার মতে পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ স্বার্থপর। অধিকাংশ মানুষই (নিশ্চয়ই তারা আল্লাহ ভীরু না) নিজের স্বার্থের জন্য মন্দ কাজ, আচরণ করবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেহ যদি ভালো আচরণ করে, ভালোবাসে। সেটা হলো ব্যতিক্রম। তখন মনে করি, রব আমাকে তার মাধ্যমে সম্মানিত করছে, ভালোবাসছে। এই আরকি।
সিহাব বলে উঠলো, “আচ্ছা ভাইয়া। তুমি তো আমাদেরকে সব সময় বলো, থিংক পজেটিভ, থিংক পজেটিভ। কিন্তু জীবনে তো কিছু খারাপ সময় আসে। খারাপ সময় আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু খারাপ সময়কে তো আর পজেটিভলি ভাবা যায় না।”
– যায়, বোকা, যায়।
ওদের তিনজনের চোখই কপালে উঠলো। ওদের হাল দেখে নেয়ামুল মুচকি হেসে বললো,
– আমার কাছে পুরো জীবনটা একটা পূর্ণিমার চাঁদের মতো। পূর্ণিমার চাঁদের অধিকাংশ জায়গাই উজ্জ্বল কিন্তু কিছুটা জায়গা জুড়ে অন্ধকার। কিন্তু কল্পনা করে দেখ ঐ অন্ধকার অংশটা না থাকলে একটা ধবধবে চাঁদকে এতটা সুন্দর লাগতো? লাগতো না। জীবনের খারাপ সময়গুলো জীবনকে সুন্দর করার জন্যই আসে।
আতিক নেয়ামুলের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে উত্তেজনার সাথে প্রশ্ন করে বসলো,
– ভাই আপনার উদাহরণটা সুন্দর। কিন্তু কিছুটা বেমানান। চাঁদের কালো অংশ চাঁদের সৌন্দর্য বাড়ায় নাকি কলঙ্ক বাড়ায়? চাঁদের কালো অংশকে তো চাঁদের কলঙ্ক বলে।
– গুড পয়েন্ট। তবে হ্যাঁ, লোকজন চাঁদের কালো অংশকে কেন চাঁদের কলঙ্ক বলে আমি জানি না। আমার মতে, ওটা চাঁদের বিউটি স্পট। কোনো সুন্দরী রমনীর ঠোঁটের নিচে ছোট একটা তিল কিংবা একটা বাঁকা দাঁত, কিংবা গালে একটা টোল যেরকম তার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়, চাঁদের কালো অংশটাই ঠিক একই কাজ করে। তিল, টোল, বাঁকা দাঁত যেমন রমনীর বিউটি স্পট। যদিও বা তিল হলো একধরনের বিনাইন টিউমার, বাঁকা দাঁত হলো দাঁতের বিন্যাসের ত্রুটি, টোল হলো মাসল প্যারালাইসিস। তবু এরা বিউটি স্পট। তেমনি চাঁদের কালো অংশও চাঁদের বিউটি স্পট।
– ওহ আচ্ছা। বুঝছি। (আতিক)
– ভাই তুমি আসলেই জোস। পজিটিভ ভাবনায় তুমি অনন্য। (সিহাব)

হামিদা বইটা বন্ধ করে দৌড়ে নিচে চলে গেল। সে হাসলেও তার গালে টোল পড়ে। কেন জানি এখন তার নিজের টোল পড়া হাসি দেখতে ইচ্ছে করতেছে। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছে। আর মনে মনে বলছে, ”রবিন কি কখনো আমার টোলের দিকে তাকিয়েছে? হয়তো তাকিয়েছে। কিন্তু এই টোলের টান তো তাকে সপ্তাহে অন্তত একবার আমার কাছে নিয়ে আসতো। কিংবা দিনে অন্তত সাতবার আমায় দেখতে চাইতো। কিন্তু না। এরকম তো কিছু হয় না। সরকারি চাকরি। অনেক ব্যস্ততা। তাই হয়তো ইচ্ছে করলেও সময় বের করতে পারে না। সময় বের করতে না পারুক, তাতে কী! ঘুমানোর আগে তো একবার আমার ছবি দেখে নিতে পারে। দেখে কি আমায়? নাকি ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে?” এরকম ভাবতে ভাবতে হামিদার হাসি মলিন হয়ে গেল। পুনরায় ছাদে চলে গেল। সূর্যের আলো কিছু ছাদের উপর এসে পড়ছে। হামিদা কেদারায় বসে ফের দিঘির দিকে তাকালো। কড়ই গাছের ডালটা এখনো শূন্য। অতিথি পাখি এখনো আসে নি। কেন জানি অতিথি পাখির উপর থেকে হামিদার মন উঠে গেছে। তাঁর মন চাচ্ছে, অতিথি পাখি যদি আর কোনো দিন এই দিঘির আশে পাশে না আসে তবে বেশি ভালো হতো। কিন্তু গোলাপি ফুল দুটোর কি হবে? এই ভাবতে ভাবতে সে আবার গল্প পড়া শুরু করলো-

“সিহাব হঠাৎ লাফিয়ে উঠলো। নেয়ামুল জিজ্ঞেস করলো, “কিরে কী হইছে?” “ভাই, টাইগার!” নেয়ামুল একটু শুকনো গলায় বললো, “কই? কোথায়? কী বলিস তুই?” তুষর হা-হা করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে সিহাবের পিছনে থাকা একটা কুকুরকে দেখিয়ে বললো, “ভাই কুকুরটা খুবই ভালো। সারারাত বাড়ি পাহারা দেয়। ও ইঁদুরও ধরে। ঐ দেখেন গর্তের দিকে গিয়ে কী যেন শুকতেছে।” সিহাব বললো, “ও কখনো আসলো? হঠাৎ পাশে শুয়ে থাকতে দেখে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি।” নেয়ামুল, আতিক, তুষর তিনজনই হেসে দিলো। আতিক বললো, “হয়তো আমাদের পিছনে পিছনে আসছে; আমরা লক্ষ্য করি নি।” নেয়ামুলের দিকে তাকিয়ে আতিক একটা প্রশ্ন করলো,
– ভাই আমি একটা জিনিস বুঝি না। মানুষের নামকরণ পদ্ধতিটা কে আবিষ্কার করছে? যেমন ছেলেদের নাম : রাকিব, জিহাদ ইত্যাদি। নামের শেষে একটা শক্ত বিরতি। কিন্তু মেয়েদের নাম: বিথী, আয়িশা, অর্পিতা ইত্যাদি নামের শেষে কেমন একটা সুর, টান। এটার কারণ কী?
– কই সবার নাম তো এমন না। ছেলের নাম তো রনি, শুভ, রানা অনেক আছে। যাদের নামের শেষে টান সুর থাকে। আবার মেয়েদেরও শক্ত বিরতিময় নাম আছে, যেমন নাযাত। (তুষর বললো)
– হ্যাঁ ভাই ঠিক আছে। তুই যেটা বলছিস সেটাও আছে, কিন্তু খুবই কম। ওটা ব্যতিক্রম ধরে নিতে পারো। (আতিক বললো)
– হ্যাঁ, আতিক কিন্তু ঠিক বলছে। অবশ্য নামের এমন রহস্যের সঠিক কারণ আমার জানা নাই। তবে একটা হাইপোসিস দাঁড় করাতে পারি। যেমন ধর, আদিযুগ থেকেই মানুষের মধ্যে এমন একটা টেনডেনসি (প্রবনতা) ছিলো যে, শিশু যদি কোনো বিশেষ সময়, স্থানে কিংবা গায়ের বিশেষ রং নিয়ে জন্মায় তবে তাদের নাম সেসব সময়, স্থান, শরীরের রং ঢং-এর সাথে মিলিয়ে রাখতো। যেমন: কার্তিক, শ্রাবণী, সাগর, নদী, ধলা মিয়া, কালু, কালিমনি ইত্যাদি।
– হ্যাঁ, সেটা তো ঠিক। (মাথা নাড়িয়ে বললো তুষর)
– আর দেখ, পুরুষ কিন্তু সব সময় উদ্যমী, বিদ্রহী, পরিশ্রমী, দুরন্ত। কিন্তু নারীরা কেমন জানি মমতাময়ী, প্রেমময়ী। তাই হয়তো পুরুষের নামের শেষে শক্ত বিরতি। যেমন নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শব্দগুলো। আর নারীর নামের শেষে কিছুটা টান, তাল, সুর মিশে থাকে। যেমন রবিন্দ্রসংগীতের প্রতিটা লাইন, শব্দে সুর মিশে থাকে।
– বাহ! বাহ! খুবই যৌক্তিক ব্যাখ্যা। তবে এখনকার যুগে তো এমন নাম রাখা হয় না সাধারণত। ( সিহাব বললো)
– হ্যাঁ। পরিবেশ, পরিস্থিতি, অভ্যাস, চরিত্রের পরিবর্তনের সাথে নামের ও পরিবর্তন আসছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। সেদিন খবরের কাগজে দেখলাম, চীনের শিক্ষার্থীদের (ছেলে) মাঠে দৌড় দেওয়ানো হচ্ছে। কারন তারা ঘরে থাকতে থাকতে মেয়েলী স্বভাবে হয়ে যাচ্ছে। (আতিক বললো)
– দেশের ছেলেদের অবস্থা ওদের থেকে ভালো, তা বলা ঠিক হবে না। এখনকার ফ্রী ফায়ারসহ অন্যান্য গেইম যোদ্ধাদের মাঠে নামিয়ে দিলে দু’মিনিটও ঠিক মতো দৌড়াতে পারবে না। পুরো বিশ্ব হয়তো এক অন্ধকার ব্ল্যাকহোলের দিকে ধাবিত হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ক্রমাগত পুরুষের y ক্রোমোজোম হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতি ১ মিলিয়ন বছরে y ক্রোমোজোমের ৫টি জিন বিলুপ্ত হচ্ছে। y ক্রোমোজোমে মোট ৫৫টি জিন।
– তার মানে, প্রায় ১১ মিলিয়ন বছর পর পৃথিবীতে পুরুষত্বের অধিকারী কোনো মানুষ থাকবে না? (সিহাব বললো)
– এমনটাই ধারনা করা হচ্ছে। তবে বিজ্ঞানীদের গবেষণা চলছে এ নিয়ে। যাই হোক, আমরা যে এতটা যন্ত্রমুখী হয়ে পড়তেছি এটা কামানো উচিত। চলাচলের জন্য মাঝে মাঝে নিজের দু’পা ব্যবহার করা উচিত। এতে নিজেরও উপকার দেশেরও উপকার। (নেয়ামুল বললো)
– হুম, একদম ঠিক বলছো। ভাইয়া আবার একটা প্রশ্ন আসছে। বলবো? (সিহাব)
– আবার প্রশ্ন? রাত পার হয়ে যাবে তো। ওদিকে বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করতেছে। বিশেষ করে নানু। আর বসে থাকা যাবে না। চল, হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন কর। আমি বলতেছি। ওরা সবাই উঠে দাঁড়ালো। আর হাঁটা শুরু করলো।
– আমি এখন পর্যন্ত যে কয়টা ঢাবির বাস দেখছি। সবগুলোর নাম সুন্দর। কিন্তু সমস্যা একটা। সবগুলো মেয়েদের নামে রাখা: বৈশাখী, চৈতালী, ক্ষণিকা।
– আরে না। ছেলেদের নামেও আছে: হেমন্ত, উল্লাস, তরঙ্গ। এরকম অনেক। আমি যেদিন প্রথম তরঙ্গ লেখা দেখি মনের অজান্তে তরঙ্গিণী পড়ে ফেলি। তবে হ্যাঁ, বাসের নাম মেয়েদের নামে হওয়া উচিত। মায়েরা (মেয়েরা) যেভাবে নিজের মধ্যে সন্তান ধারন করে, বাসও তেমনি আমাদের ধারণ করে। বুঝলি?
– হুম, বুঝছি। (সিহাব)
– ভাই আমারও একটা প্রশ্ন আছে। একেবারে শেষ প্রশ্ন। (তুষর)
– আচ্ছা বল।
– বাংলাদেশে এত এত বিশ্ববিদ্যালয়। তবে ‘স্যার বসু’র মতো কোন বিজ্ঞানী জন্ম নেয় না কেন? বিশেষ করে ঢাবি থেকে কেনো কোনো বিজ্ঞানী বের হবে না? ওখানে তো সব ট্যালেন্টদের ইনপুট হয়। তবে আউটপুট হিসেবে কেন কেবলই বিসিএস ক্যাডার? বিজ্ঞানী কেন হবে না?
– বাপরে, কী মহাপ্রশ্ন! এ প্রশ্নের জবাব আমি জানি না। তুই জানোস, টাইগার? (পিছনে কুকুরটার দিকে ফিরে)
– ভাইয়া বলো না। তোমার কাছে তো কোনো না কোনো ব্যাখ্যা আছে। সেটাই বলো।
– এর পিছনে পড়াশুনার উদ্দেশ্য, সিস্টেম, পরিবেশ। আরো অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। তবে আমি যেটা বেশি দেখেছি, ঢাবির অধিকাংশ শিক্ষার্থীই নিজের ডিপার্টমেন্ট নিয়ে সন্তুষ্ট না। তারা যেখানে আছে তার থেকে বেটার কিছু ডিজার্ভ করে। তারা মনে করে তারা যে লেভেলের মেধাবি, তারা সে লেভেলের ডিপার্টমেন্ট পায় নি। যে ‘সমুদ্র বিজ্ঞানে’ আছে সে পরিসংখ্যান’কে চায়, যে ‘পরিসংখ্যানে’ আছে সে ‘সিএসই’ চায়;এভাবে চলতে থাকে। কিন্তু তারা এটা ভুলে যায় যে, তার যোগ্যতা তাকে সর্বোচ্চ এতটুকুই দিয়েছে। যে যেটায় আছে সেটাই তার জন্য পারফেক্ট। যাইহোক, এরা ডিপার্টমেন্টকে ভালোবাসতে পারে না। পড়তে হয়, তাই পড়ে। পরীক্ষার দু’এক রাত আগে পড়েই সিজি তুলে ফেলে। কিন্তু এই প্রয়োজন মাফিক পড়ালেখা দ্বারা গবেষণার নতুন কোনো দ্বার খুলে না। দেশের জন্য উপকারী কিছু আবিষ্কারের প্রথম শর্ত নিজ ডিপার্টমেন্টকে ভালোবাসা। ডিপার্টমেন্টের পড়া ভালোবেসে পড়তে হবে। এটা কেন হয়েছে, এটা কিভাবে হয়েছে, এখানে কি বুঝাতে চেয়েছে সেটা বুঝার চেষ্টা করা। জানিস, ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের ইংরেজী কোর্স শিক্ষক একটা কথা বলতো, “এদেশে বই পোকা, আর বউ পোকার বড্ড অভাব।”

ওরা চারজন এভাবে গল্প করতে করতে বাড়ি দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর ওদের পিছনে পিছনে টাইগারও এগিয়ে যাচ্ছে। পিছন থেকে ওদের আর দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশার মাঝে ওরা হারিয়ে যাচ্ছে।”

হামিদা গল্প পড়তে পড়তে নিজের অজান্তে গল্পের ভিতর ঢুকে পড়ছে। নিজেকে বারবার খুঁজে বেরাচ্ছে গল্পের কোনো চরিত্রে কিংবা সংলাপে। খুঁজে পাচ্ছে না। বারবার তার অবচেতন মন তাকে গল্পের ডিপার্টমেন্ট হিসেবেই তুলে ধরছে। অন্য কোনো চরিত্রে তাকে স্থান দিচ্ছে না। তাই মন কিছুটা ভার করে দিঘির দিকে তাকিয়ে আছে। কড়ই গাছের ডালটা এখনো শূন্য দেখে তার ভালো লাগলো। তার ইচ্ছে হচ্ছে, “রবিন যদি এখন পাখি হয়ে আসতো; এসে ঐ শূন্য ডালটায় বসতো; সেখান থেকে উড়াল দিয়ে গোলাপি রং এর কচুরিপানা ফুল দুটো মুখে করে এনে আমার খোঁপায় গুজে দিতো; কতই না ভালো হতো। ইশশ, সে যদি পাখি হতো, ‘রবিন পাখি’ !”

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়