fbpx

সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২০

প্রিয় পাঠক, ঈদ-উল-আযহার আগের রাতে টেকনাফে পুলিশের ‘ক্রসফায়ার’-এ মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান নিহত হবার ঘটনায় মানুষ ক্ষুব্ধ। আসুন আমরা ঘরে বসেই একটু গোয়েন্দাগিরি করার চেষ্টা করি। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘armchair detective’ – তাই হবার চেষ্টা করি।

পত্রিকা পড়ে জানা গেছে, মেজর (অব.) সিনহা একটা তথ্যচিত্র নির্মাণের কাজে কক্সবাজারের একটি রিসোর্টে অবস্থান করছিলেন। তাঁকে সহযোগিতা করছিলো সিফাত, শিপ্রা আর রিফাত – এরা তিনজনই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ৩১ জুলাই সিফাতকে সাথে নিয়ে সিনহা ব্যক্তিগত গাড়িতে টেকনাফ গিয়েছিলেন কিছু দৃশ্য ভিডিও করার জন্য। রাতে কক্সবাজার ফেরার পথে টেকনাফের শামলাপুর চেকপোস্টে ইনচার্জ লিয়াকত আলী তাঁকে কয়েকটি গুলি করলে তিনি আহত হন। কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষনা করেন। সিফাতের বিরুদ্ধে পুলিশ হত্যা মামলা করেছে। এছাড়াও, মাদক মামলা করা হয়েছে সিফাত আর শিপ্রার বিরুদ্ধে।

উপরে বর্ণিত ঘটনার ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। তবে, টেকনাফ পুলিশের কিছু সদস্য ও তাঁদের সহযোগীরা যেভাবে বাকি ঘটনা বর্ণনা করেছেন এবং নিজেদের কাজের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। ‘সন্দেহ’ পর্যায়ে না রেখে পুলিশের বক্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করা যাক। 

সিনহার মৃত্যুর পর টেকনাফ থানায় দায়ের করা এজাহারে এসআই নন্দদুলাল লিখেছেন, ‘সেনাবাহিনীর মেজর পরিচয়দানকারী ব্যক্তি কিছুক্ষণ তর্ক করে গাড়ি থেকে নেমে এক পর্যায়ে কোমরের ডান পাশ থেকে পিস্তল বের করে গুলি করার জন্য উদ্যত হলে আইসি স্যার (ইনচার্জ লিয়াকত) নিজের ও সঙ্গীয় অফিসার ফোর্সদের জানমাল রক্ষার্থে সঙ্গে থাকা তাঁর নামে সরকারি ইস্যুকৃত পিস্তল হইতে চার রাউন্ড গুলি করেন।’ (প্রথম আলো, ০৩ আগস্ট ২০২০)

সিনহা অস্ত্র ব্যবহারে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছিলেন। চেকপোস্টে গাড়ি থেকে বের হয়ে অরক্ষিত অবস্থায় তিনি তাঁর ‘কোমরের ডান পাশ থেকে’ পিস্তল বের করার চেষ্টা করেছেন, এই বক্তব্য হাস্যকর। গোলাগুলি করার ইচ্ছা থাকলে তিনি নিশ্চয়ই গাড়িটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতেন। তার সঙ্গী সিফাতের বক্তব্যে জানা যায়, সিনহার নামে লাইসেন্স করা পিস্তলটি গাড়িতেই ছিলো, তাঁর কোমরে ছিলো না।

পুলিশের বক্তব্যের সত্যতা আরও ভালভাবে যাচাইয়ের জন্য সিনহার পরিবর্তে সিফাতের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক।

টেকনাফ পুলিশের হত্যা মামলায় একমাত্র আসামী করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সিফাতকে। পুলিশের ভাষায় সিফাতের অপরাধ হলো ‘পরস্পর (সিনহা ও সিফাত) যোগসাজশে সরকারি কাজে বাধা, হত্যার উদ্দেশ্যে অস্ত্র তাক করা ও মৃত্যু ঘটানো’। (প্রথম আলো, ০৩ আগস্ট ২০২০)

সিফাত কীভাবে সরকারি কাজে বাধা দিলো? পুলিশের এজাহারেই অন্য জায়গায় আছে, ইনচার্জ লিয়াকত গাড়ি থেকে বের হতে বললে ‘তিনি (সিনহা) নিজেকে সেনাবাহিনীর মেজর বলে পরিচয় দেন। তাঁর পাশে বসা ব্যক্তিটি (সিফাত) গাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন।’ ছেলেটা তো পুলিশের নির্দেশ পালন করলো। বাধা দিলো কখন?

সিফাতের দ্বিতীয় ‘অপরাধ’ হলো ‘হত্যার উদ্দেশ্যে অস্ত্র তাক করা’। পুলিশ উদ্ধার করলো মাত্র একটা পিস্তল, পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী যেটা সিনহা ‘কোমর থেকে বের করে গুলি করার জন্য উদ্যত’ হয়েছিলেন। তাহলে গাড়ি থেকে আগেই বের হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সিফাত কখন অস্ত্র তাক করলো? কোন্ অস্ত্র সেটি? পুলিশ তখন তাকে গুলি করেনি কেন?

সিফাত কীভাবে সিনহার ‘মৃত্যু ঘটালো’?

তিনটা অভিযোগের প্রত্যেকটাই ভিত্তিহীন।

পুলিশের এজাহারেই আছে, ‘সেনাবাহিনীর পোশাক পরা একজনকে’ আটকাতে শামলাপুর চেকপোস্টে গাড়ি তল্লাশির নির্দেশটা দিয়েছিলেন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ। ঘটনার পর স্ববিরোধী ও হাস্যকর এজাহার দায়েরের পরও তিনি লিয়াকত, নন্দদুলাল ও অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেননি।

যেসব পুলিশ একজন ছাত্রের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন হত্যা মামলা দিতে পারে, তাঁদের দেয়া মাদক মামলা কতটুকু সত্য? তাঁদের কোনও কথাই কি বিশ্বাস করা উচিৎ? অবিলম্বে সিফাত আর শিপ্রার বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করা হোক।

আরেকটা কথা না বললেই নয়। টেকনাফ পুলিশের এজাহারে বলা হয়েছে, লিয়াকত সিনহাকে চার রাউন্ড গুলি করেছেন। কিন্তু, পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে কক্সবাজার পুলিশের এসআই আমিনুল উল্লেখ করেছেন, মৃতদেহে ছয়টি গুলির আঘাত পাওয়া গেছে। (প্রথম আলো, ০৫ আগস্ট ২০২০)

সিনহাকে অতিরিক্ত দু’টি গুলি কোন্ পিস্তল দিয়ে কে কখন করলো, তার জবাবও লিয়াকত ও তাঁর বাহিনীকে দিতে হবে। কারণ, লিয়াকতের গুলিতে আহত হবার পর থেকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে সিনহাকে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁদের ‘হেফাজত’-এ ছিলেন।

পুলিশের ‘ক্রসফায়ার’ একটা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, যেসব পুলিশ সদস্য বিভিন্ন সময়ে সত্যিকারের ক্রসফায়ারে (অপরাধীদের সাথে গুলি বিনিময়ে) সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, তাঁদেরকে সম্মান জানাচ্ছি।

দু’দিন পরেই ১৫ আগস্ট। জাতির জনক ও তাঁর ‍পরিবারের সদস্যদের নির্মম হত্যাকান্ডের কথা স্মরণ করে আজও দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বজন হারানোর বেদনা আপনার চেয়ে বেশি আর কেউ বুঝবে না। ‘ক্রসফায়ার’-এর নামে বিনা বিচারে হত্যা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে আপনার সদয় পদক্ষেপ কামনা করছি।

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪

জাফর আহমেদ খান

প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪