fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

সাত

মানসিক হাসপাতালে আজ ভেরোনিকার প্রথম স্বাভাবিক দিন। সে ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে বড় একটা খাবার ঘরে সকালের নাস্তা করলো যেখানে নারী-পুরুষ অনেকে এক সাথে নাস্তা করছে। সে খেয়াল করে দেখলো যে জায়গাগুলো সিনেমাতে সাধারণত যেভাবে দেখানো হয় – হিস্টিরিয়াগ্রস্তদের চিত্র, চিৎকার-চেচামেচি, লোকজনের উন্মত্ত অঙ্গভঙ্গি – এসব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন; সব কিছু যেন পীড়াদায়ক নিরবতার সূক্ষ্মতায় মোড়ানো। মনে হচ্ছে কেউ এখানে নিজের জগতকে অপরিচিতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চায় না।  

সকালের নাস্তা (যেটা মোটেও খারাপ না; ভিলেট-এর ভয়ঙ্কর পরিচিতির ক্ষেত্রে কেউ অন্ততঃ খাবারকে দায়ী করতে পারবে না) শেষে সবাই বাইরে রৌদ্রস্নানে বের হলো। সত্যি কথা বলতে রোদের তাপ নেই, কারণ তাপমাত্রা শুন্যের নীচে আর পুরো বাগানটা বরফে ঢেকে আছে।

“আমি এখানে জীবন বাঁচাতে আসিনি, মরতে এসেছি,” ভেরোনিকা একজন নার্সকে বলছিলো।

“তবুও তুমি বাইরে রোদ পোহাতে যেতে পারো।”

“আপনি পাগল না কি, বাইরে তো কোন রোদই নেই।”

“বাইরে রোদ নেই, তবে আলো আছে; এটা রোগীদের শান্ত থাকতে সাহায্য করে। আমাদের তো দুর্ভাগ্য যে শীতকাল অনেক লম্বা; নইলে আমাদের আরো অনেক কম কাজ করতে হতো।”

ভেরোনিকা চিন্তা করে দেখলো তর্ক করা বৃথা। তাই আর কথা না বড়িয়ে সে বাগানে চলে এলো এবং কিছুক্ষণ হাঁটলো। হাঁটতে হাঁটতে সে চারদিকে দেখছিলো আর নিজের অজানতেই পালিয়ে যাবার পথ খুঁজছিলো। প্রাচীরগুলো বেশ উঁচু যেমনটা পুরনো ব্যারাকে হয়, কিন্তু সেন্ট্রিদের জন্য তৈরি করা ওয়াচ টাওয়ারগুলো খালি। বাগানটি সামরিক-ভবন এর মতো ভবন দিয়ে ঘেরা যেগুলো এখন পুরুষ ও নারী ওয়ার্ড, প্রশাসনিক ভবন, আর স্টাফদের রুম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। খুব দ্রুত প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে যেটা নিশ্চিত হওয়া গেলো সেটা হচ্ছে একমাত্র প্রধান ফটকই সত্যিকার ভাবে পাহারা দেয়া হচ্ছে। সেখানে দু’ জন প্রহরী আগত ও নির্গত প্রত্যেকের কাগজপত্র যাচাই করছে।

আস্তে আস্তে অনেক কিছুই তার মনে পড়তে লাগলো। স্মৃতি যাচাই করতে ভেরোনিকা ধীরে ধীরে ছোট খাটো বিষয়গুলো মনে করার চেষ্টা করছিলো যেমন, সে সাধারণত কোথায় তার রুমের চাবি রেখে যায়, কোন রেকর্ডটা সে সর্বশেষ কিনেছে, লাইব্রেরিতে সর্বশেষ তার কাছে কোন বইটা চাওয়া হয়েছে ইত্যাদি।

এ সময় একজন ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে বললেন, “আমি জেডকা।”

গত রাতে ভেরোনিকা তার চেহারাটা ভালো করে দেখতে পায়নি। কারণ কথা বলার সম্পূর্ণ সময়টাই সে বিছানার পাশে উবু হয়ে বসে ছিলো। জেডকার বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশের কোটায় হবে। তাকে দেখে সম্পূর্ণ সুস্থই মনে হচ্ছে ।

“আশা করি রাতের ইনজেকশন তোমাকে খুব কষ্ট দেয়নি। আসলে কিছু দিন অভ্যাস হয়ে গেলে দেখবে এসব চেতনানাশক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।”

“আমি ঠিক আছি।”

“তোমার কি মনে আছে কাল রাতে কী আলাপ হয়েছিলো? তুমি আমাকে কী জিজ্ঞেস করেছিলে?”

“অবশ্যই।”

জেডকা তার হাত ধরে টেনে নিয়ে উঠানের পাতা ঝরা গাছগুলোর মধ্যে দিয়ে এক সাথে হাঁটতে শুরু করলো। বাগানের প্রাচীরের পিছনে পাহাড়গুলোকে মেঘের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছিলো সেখান থেকে।

“বেশ ঠান্ডা হলেও চমৎকার সকাল, কী বলো,” জেডকা বললো। “অদ্ভুত ব্যাপার কী জানো, এরকম শীতল, ধূসর, মেঘাচ্ছন্ন দিন আমাকে কখনো বিষণ্ন করে না। আমার কাছে মনে হয় প্রকৃতি যেন আমার সাথে তাল মিলিয়ে চলছে, একেবারে আমার মনের প্রতিচ্ছবি যেন। অন্যদিকে, যখন রোদ ওঠে, বাচ্চারা খেলতে রাস্তায় বের হয়ে আসে এবং সবাই চমৎকার দিন দেখে পুলকিত হয়, তখন আমার খুব বিশ্রী লাগে। মনে হয় চারদিকে যেন এক উচ্ছ্বাসের প্রদর্শনী আর আমি সেখানে অংশগ্রহণ করতে পারছি না; খুব অশোভন লাগে ব্যাপারটা।”

ভেরোনিকা খুব শান্তভাবে ভদ্রমহিলার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। শরীরের স্পর্শটা তার পছন্দ হচ্ছিলো না।

“আপনি কাল আপনার কথা শেষ করেননি। আমি আপনাকে যে বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে বিষয়ে আপনি কিছু বলতে চাচ্ছিলেন,” ভেরোনিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললো।

“এখানে কিছু লোক আছে – নারী ও পুরুষ – যারা চাইলে এখান থেকে চলে যেতে পারেন, বা বাড়ি ফিরে যেতে পারেন কিন্তু তারা যান না। না যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। ভিলেট একটা পাঁচ তারকা হোটেল না হলেও লোকে একে যতটা খারাপ বলে ততটা খারাপ এটা না। এখানে যারা থাকেন তারা তাদের ইচ্ছা মতন কথা বলতে পারেন, মনের মতো চলতে পারেন; এ জন্য কারো কোন মন্তব্য শুনতে হয় না। কেননা তারা একটা মানসিক হাসপাতালে আছেন। সরকারি অফিস থেকে হাসপাতাল পরিদর্শনে আসলে কিছু নারী-পুরুষ ভয়ঙ্কর প্রলাপ বকতে থাকেন কারণ এখানে কিছু লোকজন আছেন যারা সরকারি খরচে থাকেন। ডাক্তাররাও এ বিষয়গুলো জানেন, কিন্তু তারপরও এমন অবস্থা চলছে। কারণ এখানে রোগীর সংখ্যা ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কম।”

“আপনি কি বলতে চান এ লোকগুলো আমার জন্য কিছু ঘুমের বড়ির ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?,” ভেরোনিকা জানতে চাইলো।

“তাদের সাথে যোগাযোগ করে দেখতে পারো, এরা এদের দলটাকে ‘ভাতৃসংঘ’ নামে ডাকে।”

জেডকা কয়েক জন তরুণীর সাথে কথা বলছে এমন একজন সাদা চুলের ভদ্রমহিলার দিকে ইঙ্গিত করলো।

“উনার নাম মারি, উনি ভাতৃসংঘ’র সদস্য, উনাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো।”

ভেরোনিকা মারির দিকে এগিয়ে যেতেই জেডকা বাঁধা দিলো। “না, এখন না। এখন উনি বেশ আনন্দের মধ্যে আছেন। একজন একেবারে অপরিচিত ব্যক্তির সাথে কথা বলতে উনি উনার সুন্দর মুহূর্তের ব্যাঘাত ঘটাবেন না। উনি যদি খুব বাজে প্রতিক্রিয়া দেখান, তাহলে তুমি আর দ্বিতীয় সুযোগ পাবে না। ‘পাগল’রা কিন্তু সব সময় প্রথম পরিচয় দিয়েই বিচার করে।”

জেডকা যেভাবে ‘পাগল’ শব্দটা বললো তাতে ভেরোনিকার হাসি পেলো। তবে তার কিছুটা দুশ্চিন্তাও হচ্ছে, কারণ এখানে সব কিছুই খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। অনেক বছরের অভ্যাসে সোজা কাজ থেকে বারে, বার থেকে কারো বিছানায়, বিছানা থেকে তার রুমে, আর রুম থেকে তার মা’র বাসায় যাতায়াতের যে জীবন, তার বাইরে এখন সে এমন কিছুর জ্ঞান লাভ করছে যার কোন চাহিদা সে কখনো অনুভব করেনি। একটা মানসিক হাসপাতাল আর পাগলামির অভিজ্ঞতা। একটা মানসিক বিকারগ্রস্তের হাসপাতাল যেখানে কেউই নিজেকে বিকারগ্রস্ত বলতে লজ্জিত বোধ করে না, যেখানে কেউই অন্যের ভালো লাগার কাজে বাঁধা দেয় না।

ভেরোনিকা ঠিক বুঝতে পারছে না জেডকা আদৌ সিরিয়াস কি না, অথবা এটা এমন নয় তো যে মানসিক রোগীরা সব সময়ই নিজেদের চিন্তাটাকে অন্যদের তুলনায় উৎকৃষ্ট মনে করে। ভেরোনিকার মনে হলো তাতে কী? সে তো সম্পূর্ণ মজাদার, ভিন্ন, আশাতীত কিছু অভিজ্ঞতা পাচ্ছে। এমন একটা জায়গার কথা ভাবতেই তো অবাক লাগছে যেখানে মানুষেরা ঠিক যা চায় তা পেতে উন্মাদের ভান করছে।

ঠিক সেই মুহূর্তেই ভেরোনিকার মন ঘুরে গেলো। তার হঠাৎ-ই মনে পড়লো ডাক্তার কী বলেছেন, এটা মনে করেই তার ভয় হতে লাগলো।

সে জেডকাকে বললো, “আমি একটু একা হাঁটতে চাই।” সে ভাবছে, আমি নিজেও তো ‘বিকারগ্রস্ত’, আর তাই অন্যকে খুশি করা নিয়ে আমার তো কোন দুশ্চিন্তা নেই। তাই জেডকা কী ভাবলো সেটা তার দেখার বিষয় না।

ভদ্রমহিলা চলে গেলেন, আর ভেরোনিকা ভিলেট-এর প্রাচীরের পেছনের পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বেঁচে থাকার একটা ক্ষীণ আকাঙ্ক্ষা মনের ভেতর ভেসে উঠতে চাইছে, ভেরোনিকা সেটাকে দাবিয়ে রাখলো।

আমাকে ঘুমের বড়িগুলো যত দ্রুত সম্ভব হাতে পেতে হবে। ভেরোনিকা ভাবছে।

সে তার পরিস্থিতি বিচার করে দেখলো তার পরিস্থিতি যথেষ্ট সঙ্গীন। এখানে যদিও সব ধরনের পাগলামি সহ্য করা হয় কিন্তু সে তো জানেই না কোথা থেকে শুরু করতে হবে।

কারণ সে তো কখনো পাগলামি করেনি।

বাগানে বেশ কিছু সময় কাটানোর পর প্রত্যেকেই আবার খাবার ঘরটায় ফিরে আসলো এবং দুপুরের খাবার খেলো। তার ঠিক পর পরই নার্সরা নারী-পুরুষ সবাইকে একটা বিশাল লিভিং রুমের দিকে নিয়ে গেলো। লিভিং রুমটা বেশ কয়েকটা অংশে বিভক্ত: সেখানে টেবিল, চেয়ার, সোফা, একটা পিয়ানো, একটা টেলিভিশন, এবং বড় বড় জানালা রয়েছে যার মধ্য দিয়ে ধূসর আকাশের নীচু মেঘগুলোকে দেখা যাচ্ছে। জানালাগুলোর খোলা অংশটা বাগানের দিকে থাকায় কোন জানালাতেই হুড়কো দেয়া নেই। দরজাগুলো ঠান্ডার কারণে বন্ধ। কিন্তু যে কেউ চাইলে দরজা খুলে আবার বাইরে গিয়ে বাগানে হেঁটে আসতে পারে।

বেশির ভাগই টেলিভিশনের সামনে বসে গেলো। বাকিদের মধ্যে কেউ ফাঁকা জায়গাটায় স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, কেউ নিজেদের মধ্যে নীচু স্বরে কথা বলতে লাগলো, কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে কেউই একই মুহূর্তে একই কাজ করছে না। ভেরোনিকা বয়স্ক ভদ্রমহিলা, মারিকে লক্ষ্য করছিলো। এখন সে একটা বিশাল রুমের এক কোনায় একটা বড় দলের সাথে রয়েছে। কিছু রোগী তার কাছাকাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভেরোনিকা তাদের সাথে যোগ দেয়ার আর দলের লোকজনের আলাপ আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করছিলো।

সে যতটা পারা যায় তার অভিপ্রায় লুকানোর চেষ্টা করে যখনই তাদের কাছাকাছি আসলো সবাই চুপ হয়ে গেলো এবং তার দিকে ঘুরে তাকালো।

“তুমি কী চাও?” একজন বয়স্ক লোক জিজ্ঞেস করলেন। লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছে সে এই ভাতৃসংঘের মুরুব্বি (যদি সত্যিই এমন কোন দল থেকে থাকে এবং যদি জেডকা ভেরোনিকার ধারণার চেয়েও বেশি উন্মাদ না হয়ে থাকেন)।

“কিছু না, আমি শুধু এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম।”

তারা নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলো এবং মাথা ঝাকালো। তাদের একজন বলে উঠলো, “সে শুধু এদিক দিয়ে যাচ্ছিলো।” অন্যরা তার কথাটাই জোরে পুনরাবৃত্তি করলো, এবং খুব তাড়াতাড়ি সবাই এই কথা বলে চিৎকার করতে লাগলো।

কী করবে বুঝতে না পেরে ভেরোনিকা ভয়ে অবশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। একজন স্থূল, চতুর দেখতে পুরুষ নার্স এগিয়ে এসে জানতে চাইলো কী হচ্ছে এখানে।

“কিছু না,” তাদের দলের একজন সদস্য বললো। “সে শুধু এদিক দিয়ে যাচ্ছিলো। সে ওখানটাতে দাঁড়িয়ে, কিন্তু এখনো সে এখান দিয়ে যাচ্ছে।”

পুরো দলটা হাসিতে ফেটে পড়লো। এই বিদ্রূপাত্মক পরিবেশে ভেরোনিকা একটু হেসে ঘুরে দ্রুত সরে গেলো যেন কেউ তার চোখের জলটা দেখতে না পারে। সে কোন কোট বা জ্যাকেটের তোয়াক্কা না করে সোজা বাগানে চলে গেলো। একজন নার্স তাকে ভেতরে যেতে বেশ কয়েকবার অনুরোধ করলো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে অন্য একজন নার্স এসে তার কানে কানে কী বলতেই দু’জনে তাকে ঠান্ডার মধ্যে রেখে চলে গেলো। যে মরতেই যাচ্ছে তাকে যত্ন নেয়ার কিছু নেই।   

সে নিজেকে নিয়ে বিভ্রান্ত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও বিরক্ত। সে কখনোই ক্ষেপে যায় না; ছোট থাকতেই সে শিখেছে নতুন পরিস্থিতিতে শান্ত ও দূরবর্তী অবস্থানে থাকতে হয়। অথচ এই উন্মাদ লোকগুলো তাকে লজ্জিত, ভীত, ক্রোধান্বিত করে ফেলছে। এদের সবাইকে খুন করে ফেলতে মন চাচ্ছে, মনে হচ্ছে এদের এমন কড়া কথা শুনিয়ে দিতে যেটা সে জীবনে কাউকে বলেনি।

সম্ভবত কোমা অবস্থা থেকে বের করে আনতে যে ওষুধ বা চিকিৎসা দেয়া হয়েছে তা ভেরোনিকাকে দুর্বল করে ফেলেছে এবং নিজেকে সামলে রাখার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। বয়োসন্ধিকালে এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি তাকে হতে হয়েছে, কিন্তু আজ প্রথমবারের মতো চোখের জল সে আটকাতে পারেনি। ভেরোনিকার মনে হলো নিজের ভেতরের মানুষটাকে তার ফিরে পেতে হবে যে মানুষটা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের জবাব দিতে পারে এবং এ ভান করতে পারে যে, এগুলো বিদ্রূপ তাকে কিছু করতে পারে না কারণ সে তাদের থেকে অনেক উৎকৃষ্ট মানের একজন মানুষ। ঐ দলের কে আছে যে নিজের মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা করতে পারে? ভিলেট-এর প্রাচীরের পেছনে ভীড় করে এদের কে তার মতো মানুষকে জীবন সম্পর্কে শিক্ষা দিতে পারে? তাকে যদি মৃত্যুর জন্য পাঁচ বা ছয় দিনও অপেক্ষা করতে হয় তবুও সে কোন সাহায্যের জন্য এদের উপর নির্ভর করতে চায় না।

এক দিন প্রায় চলে গিয়েছে। আর মাত্র চার বা পাঁচ দিন রয়েছে। ভেরোনিকা ভাবছিলো।

হিম শীতলতা শরীরে নিতে সে কিছুটা হাঁটলো, এতে তার দ্রুত চলা হৃদস্পন্দন কিছুটা শান্ত হলো।

ভেরোনিকা ভাবছিলো এখানে আমি গুনে গুনে কয়েকটি দিনের জন্য আছি; আর আমি কি না এমন কিছু লোকের মন্তব্যকে গুরুত্ব দিচ্ছি যাদেরকে আমি আগে কখনো দেখিইনি, এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে আর কখনো দেখবোই না। এমন কি আমি কষ্ট পাচ্ছি ও মন খারাপও করছি; আমি নিজেকে রক্ষা করতে আক্রমণ করতে চাচ্ছি। কেন আমি আমার সময় নষ্ট করছি?

এই ছোট্ট জায়গায় অদ্ভুত প্রজাতির কিছু লোকজনের জন্য নিজের সাথে যুদ্ধ করতে সে তার অবশিষ্ট সামান্য সময়টুকু অপচয় করছিলো কেননা যখন কেউ নিজের উপর অন্যের চাপানো নিয়ম মানতে চায় না তখন তো লড়াই-ই অনিবার্য।

নিজের আচরণকে আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, আমি তো কখনো এমন ছিলাম না। আমি কখনোই নির্বোধ বিষয়ে লড়াই করিনি।

ভেরোনিকা বরফাচ্ছাদিত বাগানের মধ্যখানে গিয়ে থামলো। সবকিছুই তার কাছে এতো অসাড় মনে হচ্ছিলো যে জীবনে যেটা স্বাভাবিকভাবেই ঘাড়ে এসে পড়েছে সেটা সে বাধ্য হয়েই মেনে নিলো। বয়োসন্ধিকালে তার মনে হতো জীবনকে এভাবে মেনে নেয়াটার জন্য তার বয়স খুব কম; আর এখন মনে হচ্ছে মেনে নেয়ার মনোভাবটা পরিবর্তন করার জন্য যথেষ্ট সময় চলে গিয়েছে।

এখন পর্যন্ত সে তার জীবনীশক্তি কী করে ব্যবহার করতে পারতো? শুধুমাত্র জীবন যেভাবে কাটছিলো ঠিক সেভাবেই কাটিয়ে দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখে। সে তো তার অনেক চাওয়া-পাওয়া বিসর্জন দিয়েছে যেন তার মা-বাবা তাকে ছেলেবেলার মতোই ভালোবেসে যায়; যদিও সে জানতো যে প্রকৃত ভালোবাসা সময়ের সাথে পরিবর্তন হয় ও বৃদ্ধি পায় এবং নিজেকে নতুন নতুন পন্থায় প্রকাশ করে। একদিন যখন তার মা’কে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে শুনলো যে, তার সংসার ভেঙ্গে গেছে তখন ভেরোনিকা তার বাবাকে খুঁজে বের করলো; চিৎকার চেচামেচি করলো, হুমকি দিলো এবং শেষ পর্যন্ত তার কাছ থেকে এ প্রতিশ্রুতি আদায় করলো যে সে বাড়ি ছেড়ে যাবে না। তখন সে একবারও ভাবেনি যে এর জন্য তার মা-বাবাকে অনেক মূল্য দিতে হবে।

যখন সে চাকরি করার সিদ্ধান্ত নিলো তখন তার সদ্য সৃষ্ট দেশের নতুন একটি কোম্পানির লোভনীয় চাকরির প্রস্তাব বাতিল করে একটা পাবলিক লাইব্রেরির চাকরি নিলো। যদিও এ চাকরিতে তার বেতন কম কিন্তু এখানে সে অনেক নিরাপদ বোধ করে। সে প্রতিদিন একই সময় ধরে কাজে যায়, তার সুপারভাইজার থেকে যেন কখনো কথা শুনতে না হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখে। চাকরি নিয়ে সে সন্তুষ্ট; এ জন্য তাকে কোন কঠোর সংগ্রাম করতে হয়নি, ফলে তার উন্নতিও হয়নি। সে মাস শেষে বেতন নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলো।

সে আশ্রমে রুম ভাড়া নিয়েছে কারণ সন্যাসীদের এ আশ্রমে সব ভাড়াটেদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রুমে ফিরতে হয়; তারপর দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। কেউ সময়ের পর ফিরলে তাকে রাস্তায় রাত কাটাতে হবে এমন ব্যবস্থা। ফলে হোটেল রুমে বা অপরিচিত বিছানায় রাত না কাটানোর জন্য বয়ফ্রেন্ডকে সব সময়ই সে একটা সত্যিকার অজুহাত দেখাতে পারে।

সে যখন বিয়ের স্বপ্ন দেখতো তখন সে নিজেকে ল্যুবল্জানা’র বাইরে একটা ছোট্ট বাড়িতে এমন একজন পুরুষের কল্পনা করতো যে তার বাবার থেকে ভিন্ন – যে কি না পরিবারের জন্য যথেষ্ট আয় করে, যে কি না তার বাড়িতে খোলা আগুনের পাশে বাইরের তুষার ঢাকা পাহাড়ের দিকে চেয়ে থেকে শুধুমাত্র তার সাথে সময় কাটাতে ভালোবাসে।

সে মানুষকে যথাযথ পরিমাণ সুখ দিতে শিখেছিলো – বেশিও না কমও না, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু। সে কারো সাথে রাগ করতো না, কারণ রাগ করা মানেই প্রতিক্রিয়া দেখানো, শত্রুর সাথে লড়াই করা এবং প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসার মতো অযাচিত ফলাফলের মুখোমুখি হওয়া।

যখন সে তার মতো করে জীবনের সব কিছুই অর্জন করলো, তখনই সে বুঝতে পারলো যে তার অস্তিত্বের কোন অর্থ নেই, কারণ তার প্রতিটি দিনই অভিন্ন। এ কারণেই তাকে মৃত্যু বেছে নিতে হলো।

এসব ভাবনা শেষ হতে ভেরোনিকা ফিরে চললো এবং রুমের কোনায় যেখানে ঐ দলটা ভীড় করে আছে হেঁটে সেখানে হাজির হলো। লোকগুলো খুব উৎফুল্ল হয়ে কথা বলছিলো, কিন্তু সে পৌঁছানো মাত্র সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেলো।

ভেরোনিকার কী হলো সে সোজা সবচে’ বয়স্ক লোকটা যাকে তাদের নেতা বলে মনে হচ্ছিলো তার কাছে গেলো। কেউ থামানোর আগেই ভেরোনিকা লোকটার গালে সশব্দে একটা চড় বসিয়ে দিলো।

“কি, কিছু বলবেন না এখন?” সবাই শুনতে পায় এমন উচ্চস্বরে সে জিজ্ঞেস করলো। “কিছু করতে ইচ্ছা হচ্ছে না আমাকে?”

লোকটা তার গালে হাত বুলাতে বুলাতে উত্তর দিলো, “না”। ভেরোনিকা লক্ষ্য করলো তার নাক দিয়ে একটা ছোট রক্তধারা বেয়ে পড়ছে। “তুমি খুব বেশি দিন আমাদের সাথে ঝামেলা করতে পারবে না।”

ভেরোনিকা লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে বিজয়ীর বেশে তার ওয়ার্ডের দিকে ফিরে চললো। সে এমন একটা কাজ করেছে যেটা তার সারা জীবনে সে কখনো করেনি।

জেডকা যাকে ভাতৃসংঘ বলছে তাদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর তিন দিন চলে গেলো। ভেরোনিকা চড়টার জন্য অনুশোচনা করছিলো। অনুশোচনাটা লোকটার প্রতিক্রিয়া দেখানোর ভয়ে না, আসলে সে একটা অন্যরকম কিছু করে ফেলেছে সে কারণে। নিজ থেকে সতর্ক না থাকলে ভেরোনিকা হয়তো প্রায় মেনেই নিতো যে, জীবনে বেঁচে থাকাটা মূল্যবান; আর সেটা হতো তার জন্য চরম কষ্টকর। কারণ তাকে খুব দ্রুতই পৃথিবী ছেড়ে যেতে হবে।

যে কোন উপায়ে নিজেকে অপরিবর্তিত রাখতে এবং ভিলেট-এর নিয়মকানুন মেনে চলতে ভেরোনিকার একমাত্র উপায় ছিলো প্রতিটি জিনিস ও প্রতিটি মানুষ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা। সে নিজেকে হাসপাতালের চাপিয়ে দেয়া রুটিনের সাথে মানিয়ে নিলো: ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, সকালের নাস্তা করা, বাগানে হাঁটা, দুপুরের খাবার খাওয়া, লিভিং রুমে যাওয়া, আবার বাগানে হাঁটা, রাতের খাবার খাওয়া, টেলিভিশন দেখা এবং ঘুমুতে যাওয়া।

ভেরোনিকা ঘুমুতে যাবার আগে সব সময় একজন নার্স তাকে ওষুধ খাওয়াতে হাজির হয়। অন্যান্য সবাই-ই বিভিন্ন ওষুধ খায়, শুধুমাত্র ভেরোনিকাকে ইনজেকশন দেয়া হয়। এ ব্যাপারে তার কোন অভিযোগ নেই। তার শুধু একটা বিষয়ই জানার যে, তার ঘুমের কোন সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও তাকে এতো চেতনানাশক ওষুধ দেয়া হয় কেন। তারা অবশ্য তাকে বুঝিয়ে বলেছে যে, ইনজেকশন কোন চেতনানাশক ওষুধ নয়, এটা তার হার্টের ওষুধ।

আর তাই, এই রুটিনমাফিক চলতে গিয়ে হাসপাতালের দিনগুলোও তার কাছে একইরকম লাগতে শুরু করলো। সব দিনই যখন একরকম হয়, তখন তা খুব দ্রুত অতিক্রম করে; আরো দু’তিন দিন পর তাকে হয়তো আর দাঁত ব্রাশ করতে হবে না, চুল আচড়াতে হবে না। ভেরোনিকার লক্ষ্য করছিলো যে, তার হার্ট দ্রুতই দুর্বল হয়ে পড়ছে। খুব সহজেই তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, তার বুকে ব্যথা হচ্ছে, তার খিদে পাচ্ছে না এবং সামান্যতম নড়াচড়াতেই তার অবসন্ন লাগছে।

ভাতৃসংঘের সাথে ঐ ঘটনার পর সে মাঝে মাঝে ভেবেছে: আমার কি কোন সুযোগ ছিলো, আমি কি আরো আগে বুঝতে পারতাম যে আমার দিনগুলো একই রকম লাগার কারণ আমি দিনগুলো এভাবেই চেয়েছিলাম, সম্ভবতঃ…

কিন্তু উত্তরটা সব সময় একই: আসলে ‘সম্ভবতঃ; বলতে কিছু নেই, কারণ এটা ফেরানোর কোন সুযোগ নেই। এরপরই তার ভেতরে স্বস্তি ফিরে আসতো কারণ সবকিছুই ইতিমধ্যে ঠিক হয়ে গিয়েছে।

এর মধ্যে জেডকার সাথে তার একটা সুসম্পর্ক তৈরি হয়ে গেলো (বন্ধুত্ব নয়, সুসম্পর্ক; কেননা বন্ধুত্বের জন্য একত্রে আরো সময় কাটানোর প্রয়োজন, যেটা সম্ভব নয়)। তারা একসাথে তাস খেলতো, তাতে তাদের সময় দ্রুত কাটতো। এছাড়া কখনো কখনো একসাথে নিরবে বাগানে হাঁটতো।

কোন এক সকালে নাস্তার পর পরই সবাই নিয়মানুযায়ী রোদ পোহাতে গেলো। এ সময় একজন নার্স এসে জেডকাকে তার ওয়ার্ডে ফিরে যেতে বললো। আজ জেডকার চিকিৎসার দিন।

ভেরোনিকা জেডকার সাথে নাস্তা করছিলো সে সময়, সে-ও এ অনুরোধ শুনতে পেলো।

“এটা কী চিকিৎসা?” ভেরোনিকা জানতে চাইলো।

“এটা ষাট দশকের একটা পুরনো চিকিৎসা, কিন্তু ডাক্তারদের ধারণা এটা আমাকে দ্রুত উপশম করবে। তুমি কি আমার সাথে এসে দেখতে চাও?”

“তুমি বলেছিলে তুমি বিষণ্ন ছিলে। তোমার শরীরে যে রাসায়নিক ঘাটতি রয়েছে সেটা কি ওষুধ দিয়ে সারানো যায় না?”

“চলো, দেখবে,” জেডকা একটু জোরই করলো।

আমি আবারো রুটিনের বাইরে যাচ্ছি, ভেরোনিকা নিজের সম্পর্কে ভাবছিলো। আমি আবারো নতুন কিছু জানতে চাচ্ছি যেটার কোন প্রয়োজন নেই – আমার দরকার ধৈর্যশীল হওয়া। কিন্তু কৌতুহলের কাছে ভেরোনিকা পরাজিত হলো এবং সাথে যেতে সম্মতি জানালো।

“এটা তো কোন প্রদর্শনী নয়, না কি?” নার্সটি বললো।

“ও মারা যাচ্ছে। ও তেমন কিছুই দেখেনি। ওকে আসতে দাও আমাদের সাথে।” জেডকা নার্সকে অনুরোধ করলো।

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০