fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

চার

ভেরোনিকা বুঝতে পারছিলো না সে কতক্ষণ ঘুমিয়েছে। তবে তার মনে পড়লো একটা সময়ে সে জীবন নিয়ে জেগে উঠেছিলো, আর তার নাকে-মুখে বেশ কিছু টিউবও ছিলো।

জেগে উঠতে উঠেতে সে একটা কণ্ঠ শুনতে পেলো, “তুমি কি চাও আমি তোমাকে কামোত্তেজিত করে তুলি?”

চোখ মেলে রুমের চারদিকে দেখে সে ঠিক বুঝতে পারছিলো না, সে কি সত্যি শুনেছে না কি অলীক কোন কণ্ঠ এটা। এ স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই তার মনে পড়ছিলো না, একদমই না।

ভেরোনিকা দেখলো শরীর থেকে টিউবগুলো খুলে নেয়া হয়েছে, কিন্তু সারা শরীরে অনেকগুলো সুঁই থাকায় নড়াচড়া করা যাচ্ছে না। হার্ট আর মাথার চারপাশে অনেকগুলো তার পেচানো অবস্থায় রয়েছে এবং তার হাতগুলো এখনো বাঁধা। তার নগ্ন শরীরটা একটা চাদর দিয়ে ঢাকা; তার বেশ ঠান্ডা লাগছে, তবে এ ব্যাপারে কোন অভিযোগ করতে ইচ্ছা করছে না। ছোট্ট জায়গাটা একটা সবুজ পর্দা দিয়ে ঘেরা যেখানে সে একটা বিছানায় শুয়ে রয়েছে; এছাড়া চারপাশে ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট-এর যন্ত্রপাতি আর একটা সাদা চেয়ার রয়েছে যেখানে একজন নার্স বসে বই পড়ছে।

এবারের ভদ্রমহিলার চোখ কালো ও চুল বাদামি। ভেরোনিকা ঠিক নিশ্চিত না যে এ ভদ্রমহিলার সাথেই সে কয়েক ঘন্টা বা কয়েক দিন আগে কথা বলেছিলো কি না?

“আপনি কি আমার হাত দু’টো খুলে দিতে পারেন?” ভেরোনিকা নার্সটিকে জিজ্ঞেস করলো।

নার্সটি তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে রূঢ় ভঙ্গিতে একটা “না” বলে আবার বই-এর মধ্যে ডুবে গেলো।

আমি বেঁচে আছি, ভেরোনিক ভাবছিলো।

প্রত্যেকটি জিনিসই আবার শুরু হতে যাচ্ছে। আমাকে এখানে কিছু দিনের জন্য থাকতে হবে যত দিন না তারা বুঝতে পারে যে আমি পুরোপুরি ঠিক আছি। তখন তারা আমাকে বের হতে দিবে এখান থেকে এবং আমি আবার ল্যুবল্জানা’র পথঘাট, এর মূল স্কয়ার, ব্রিজ, মানুষের চলাচল সব দেখতে পাবো।

যেহেতু মানুষ সব সময় অন্যকে সহযোগিতা করতে চায় – শুধুমাত্র এ কারণে যে, তারা নিজেদের অবস্থানকে সব সময় উৎকৃষ্ট মনে করে – তাই লাইব্রেরির চাকরিটা তারা আমাকে ফিরিয়ে দিবে। এর মধ্যে আমি আবার সেই বারে ও নাইটক্লাবে যাতায়াত শুরু করবো, আমার বন্ধুবান্ধবদের সাথে বিশ্বের সমস্যা ও অবিচারগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করবো, সিনেমা দেখতে যাবো, আর লেকের চারপাশে হেঁটে বেড়াবো।

শুধুমাত্র ঘুমের ওষুধ খাওয়ার কারণে আমাকে মানুষ হয়তো আমাকে অতটা বাজে ভাবে দেখবে না। আমি এখনো তরুণ, দেখতে ভালো, বুদ্ধিমতী; এ কারণে হয়তো একজন প্রেমিক খুঁজে পেতেও কোন সমস্যা হবে না, যেটা আমি কখনোই করিনি। আমি তার সঙ্গে তার ঘরে কিংবা কোন সবুজে ঘেরা প্রান্তরে ভালোবেসে সময় কাটাবো। আমার আনন্দের হয়তো একটা সুনির্দিষ্ট সীমা থাকবে; কিন্তু যে মুহূর্তে আমি আমার চরম উত্তেজনায় পৌঁছাবো তারপরই আবার সে শূন্যতা ফিরে আসবে। আমাদের দু’ জনের হয়তো তেমন কিছু বলারও থাকবে না। “আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে” বা “আমাকে কাল খুব সকালে উঠতে হবে” এমন অজুহাত তুলে কেউ কারো দিকে না তাকিয়েই একজন আর একজন থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ারও সময় চলে আসবে।

আমি আমার আশ্রমের ভাড়া করা রুমটায় ফিরে আসবো। আমি হয়তো একটা বই পড়ার চেষ্টা করবো, টিভি ছেড়ে কিছু পুরনো একই অনুষ্ঠান দেখবো, প্রতিদিনের মতো ঘুম থেকে উঠতে এলার্ম দিবো, এবং লাইব্রেরিতে মেশিনের মতো একই কাজ করে যাবো। থিয়েটারের উল্টো পাশের পার্কটাতে প্রতি দিনের বেঞ্চটাতে বসে লাঞ্চ করবো যেখানে অন্যান্য বেঞ্চগুলোতেও প্রতিদিনের লোকগুলোই থাকবে; মানুষগুলোর চোখে একই রকমের শুন্য দৃষ্টি থাকবে যদিও তারা এমন একটা ভাব নেয়ার চেষ্টা করবে যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ভাবছে।

এরপর আমি আবারো কাজে ফিরে যাবো; গিয়ে শুনবো কার সঙ্গে কার কী হলো, কে কী নিয়ে যন্ত্রণা পোহাচ্ছে, কে তার স্বামীর জন্যে কেঁদে বুক ভাসালো এ সব গালগপ্প। দিন শেষে ফিরে আসবো এ আত্মতৃপ্তি নিয়ে যে আমি অন্যদের থেকে ভালো আছি – আমি দেখতে ভালো, আমার একটা চাকরি আছে এবং মন চাইলে আমি একজন বয়ফ্রেন্ডও জুটিয়ে ফেলতে পারি। তাই দিনের শেষে আবারো বারে যাওয়া এবং পুরো একই জীবন আবার শুরু হওয়া।

আমার মা হয়তো অস্থির হয়ে উঠেছেন আমার আত্মহত্যার চেষ্টায়; তিনিও এক সময় এ ধাক্কা কাটিয়ে উঠবেন এবং আমাকে বার বার এ কথা বলতে থাকবেন যে, আমি আমার জীবন নিয়ে কী করতে চাচ্ছি, কেন আমি অন্যদের মতো না, জীবন আসলে এতোটা জটিল না যতটা আমি ভাবছি ইত্যাদি ইত্যাদি। “আমাকে দেখো, তোমার বাবাকে আমি অনেক বছর বিয়ে করেছি, এবং আমি তোমাকে আমাদের সেরাটা দিয়ে এবং যথাসম্ভব একটা ভালো মেয়ে হিসেবে বড় করার চেষ্টা করেছি।”

একদিন হয়তো তার একই প্যাচাল শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে তাকে খুশি করতে কোন একজনকে বিয়ে করে ফেলবো যাকে ভালোবাসতে আমি বাধ্য থাকবো। এরপর সে আর আমি মিলে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার একটা উপায় খুঁজে বের করবো – একটা বাড়ি, বাচ্চা-কাচ্চা, ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ প্রভৃতি নিয়ে। আমরা হয়তো দাম্পত্য জীবনে প্রথম বছর প্রায়ই মিলিত হবো, দ্বিতীয় বছর কিছু কম; এবং তৃতীয় বছরে মানুষ যেমনটা ভাবে সপ্তাহে একবার কিন্তু বাস্তবে হয়তো মাসে একবার মিলিত হবো। আমাদের মাঝে হয়তো তেমন কথাই হবে না। আমিও নিজেকে এ অবস্থা মানিয়ে নিতে প্ররোচিত করবো এবং ভেবে অবাক হবো যে আমার সমস্যা কী, সে তো আমাকে আগের দৃষ্টিতে দেখছে না, এড়িয়ে চলছে এবং বেশির ভাগ সময়ই সে তার বন্ধুদের সাথে সময় কাটাচ্ছে যেন তারাই পৃথিবীতে তার সবকিছু।

যখন সংসারটা প্রায় ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হবে তখন আমার শরীরে হয়তো নতুন জীবনের অস্তিত্ব আসবে। আমাদের একটা বাচ্চা হবে, কিছু দিনের জন্য আমরা নিজেদের কাছাকাছি আসবো, এবং তারপর অবস্থা আবারো আগের মতোই হবে।

আমি হয়তো ঐ নার্স যেমন গতকাল বা কয়েক দিন আগে বলছিলো তার আন্টির কথা তার মতো মোটা হতে থাকবো। আমি আসলেই জানি না কী হবে। আমি হয়তো নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবো যেটা প্রতি দিন, প্রতি সপ্তাহে ব্যর্থ হবে; ওজন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও এটা ধীরে ধীরে বেড়েই চলবে। সে সময় আমি হয়তো যাদুকরী ওষুধগুলো খাওয়া শুরু করবো যেটা বিষণ্নতা থেকে মুক্তি দেয়। তারপর আমার হয়তো আরো কিছু ছেলেমেয়ে হবে, কিছু ভালোবাসার রাত কাটবে যেগুলো খুব দ্রুতই পেরিয়ে যাবে। আমি সবাইকে বলে বেড়াবো যে, এই ছেলেমেয়েগুলোর জন্যই আমার বেঁচে থাকা; কিন্তু আসল সত্যিটা হচ্ছে তাদের বেঁচে থাকার জন্যই আমি।

চারপাশের মানুষগুলো সব সময়ই আমাদেরকে একটা সুখী পরিবার হিসেবে জানবে, কিন্তু কেউ-ই জানবে না যে এই সুখের নীচে কতটা একাকীত্ব, তিক্ততা আর পরাজয় রয়েছে।

এমনই জানবে মানুষ, অন্ততঃ যেদিন পর্যন্ত না প্রথমবারের মতো আমার স্বামীর একজন প্রেমিকা আবির্ভূত হবে এবং আমি ঐ নার্সের আন্টির মতো চিৎকার চেচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলবো অথবা নিজেকে শেষ করে ফেলার চেষ্টা করবো। কিন্তু তখন দু’ তিন বাচ্চার মা হিসেবে আত্মহত্যা করার মতো বয়স ও সাহস কোনটাই হয়তো আমার থাকবে না; আমার সব সময়ই মনে হবে আমার ছেলেমেয়েদের আমাকে বড় করতে হবে; আমি নিঃশেষ হওয়ার আগেই তাদের এই পৃথিবীতে দাঁড় করিয়ে দিয়ে যেতে হবে। আমার বোধ শক্তি ফিরে আসবে, আমি নিজেকে শেষ করতে পারবো না। আমি তখন হয়তো সংসার ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দিবো এবং আমার ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে যাবো। অন্য সব পুরুষের মতো আমার স্বামীও ফিরে আসবে, আর আমাকে বলবে সে আমাকেই ভালোবাসে, এমনটা আর কখনোই হবে না। অথবা তার ক্ষেত্রে এরকমটা না-ও ঘটতে পারে যদি আমি সত্যিই তাকে ছেড়ে চলে আসি। সেক্ষেত্রে আমার একমাত্র উপায় আমার বাবা-মা’র কাছে ফিরে আসা এবং বাকি জীবন তাদের কাছেই কাটানো। আর সারা জীবন আমার মা’র কাছ থেকে এ কথা শুনতে থাকা যে, আমি জীবনে সুখী হওয়ার এক চমৎকার সুযোগ হাতছাড়া করেছি। কিছু ছোট খাটো ত্রুটি ছাড়া সে স্বামী হিসেবে একজন চমৎকার মানুষ ছিলো এবং আমাদের আলাদা থাকাটা আমাদের ছেলেমেয়েকে ভীত করে তুলছে।

আমি যদি তাকে ছেড়ে চলে না-ও আসি, দুই বা তিন বছর পর হয়তো আবার অন্য কোন নারী তার জীবনে আসবে। তাদেরকে কোথাও একসাথে দেখে কিংবা কারো মুখ থেকে তাদের কথা শুনে আমি হয়তো ব্যাপারটা জানতে পারবো। কিন্তু এবারে আমি কিছুই জানি না এমন একটা ভাব করেই থাকবো, কেননা আগের প্রেমিকার পেছনে ছুটে আমি আমার সমস্ত শক্তিক্ষয় করে ফেলেছি ততদিনে; আমার আর সে শক্তি নেই। আমার সে সময় মনে হবে সব চেয়ে ভালো হচ্ছে সত্যিকার জীবনটা মেনে নেয়া এবং কল্পনায় ভেসে না যাওয়া। আমার মা’র চিন্তাই আমার কাছে সঠিক বলে মনে হবে।

সে একজন সহানুভূতিশীল স্বামী হিসেবেই থাকবে আমার কাছে; আমিও লাইব্রেরিতে আমার কাজ চালিয়ে যাবো, থিয়েটারের উল্টো পাশের স্কয়ারে স্যান্ডউইচ দিয়ে লাঞ্চ করবো, কখনোই শেষ করতে না পারার স্বভাব নিয়ে বই পড়বো, দশ-বিশ-পঞ্চাশ বছর আগের মতোই টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখে দিন কাটাবো। 

এছাড়া মুটিয়ে যাচ্ছি এ আক্ষেপ নিয়ে স্যান্ডউইচ খেয়ে যাবো, আর কখনোই বারে যাবো না কারণ আমার স্বামী আমার বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করবে ছেলেমেয়েদের দেখা শোনা করার জন্য।

এতকিছুর পরও বিষয়টা আসলে ছেলেমেয়েদের বড় হওয়ার অপেক্ষা করা এবং কিছু করতে পারার মতো সাহসের অভাব নিয়ে, সারাদিনমান আত্মহত্যা করতে চাওয়ার চিন্তা করা। হয়তো কোন এক চমৎকার সকালে আমি বুঝতে পারবো এটাই জীবন; দুশ্চিন্তা নিয়ে কাটানোর কিছু নেই, এখানে পরিবর্তন হওয়ার মতো কিছু নেই। চূড়ান্তভাবে একেই আমি মেনে নিবো।

ভেরোনিকা তার মনের কল্পনার রাশ টানলো এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো যে, সে জীবিত অবস্থায় ভিলেট ছেড়ে যাবে না। সবচেয়ে ভালো হতো এখনই সব কিছু শেষ করে দিতে পারলে, অন্ততঃ মরে যাওয়ার মতো সাহস ও শারীরিক সামর্থ তার যথেষ্ট রয়েছে।

ভেরোনিকা বেশ কয়েকবার ঘুমিয়ে পড়লো ও জেগে উঠলো। প্রতি বারই সে খেয়াল করছিলো যে, তার চারপাশের যন্ত্রপাতিগুলো কমে আসছে, তার শরীরের উষ্ণতা বাড়ছে এবং নার্সদের চেহারা পরিবর্তন হচ্ছে; কিন্তু সবসময়ই কেউ না কেউ তার পাশে রয়েছে। যখনই জ্ঞান ফিরেছে তখনই সবুজ পর্দার ওপাশ থেকে সে শুনেছে কারো কান্না বা গোঙ্গানোর শব্দ অথবা কিছু শান্ত পেশাদারি ফিসফিসানি। কখনো কখনো দূরে কিছু যন্ত্রপাতির গুঞ্জন আর করিডোর ধরে দ্রুত পা ফেলার শব্দ তার কানে এসেছে। তারপরই কণ্ঠস্বরগুলো তাদের শান্ত, পেশাদারি ভাব হারিয়ে চাপা উত্তেজনায় দ্রুত নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে।

একবার জ্ঞান থাকা অবস্থায় একজন নার্স তাকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কি জানতে ইচ্ছা করছে না তুমি কেমন আছো?”

“আমি জানি,” ভেরোনিকা উত্তর দিলো। “আমার শরীরে যেটা হতে দেখছেন সেটা কিছু না বরং আমার মনে যেটা হচ্ছে সেটা নিয়ে কিছুই করার নেই।”

নার্সটি আলাপ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু ভেরোনিকা ঘুমের ভান করে পড়ে রইলো।

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০