fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

সতেরো

সুফি সম্রাট ধ্যান শেষে চলে গেলেন। মারি ভাতৃসংঘের অন্যান্য সদস্যদের সাথে কথা বলতে কিছুক্ষণ খাবার ঘরটাতে রইলো। ভেরোনিকা বললো সে ক্লান্ত এবং এখনই চলে যাবে; তাছাড়া তাকে সকালে যে চেতনানাশক দেয়া হয়েছে তা একটা ঘোড়াকে শুইয়ে ফেলতে পারে, তবু তার এখনো কিছুক্ষণ জেগে থাকার শক্তি রয়েছে।

“এটা তোমার তারুণ্য; এটা তোমার শরীর কতটা পারে সেটার তোয়াক্কা না করেই নিজের সীমা তৈরি করে নিয়েছে। যদিও তোমার শরীরও নিতে পারে,” মারি ভেরোনিকাকে বলছিলো।

মারি ক্লান্ত ছিলো না; সে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। তারপর ল্যুবল্জানা’য় বেড়াতে বের হয়েছিলো – ডা. ইগোর-এর নির্দেশে ভাতৃসংঘের সদস্যদের প্রতিদিন ভিলেট থেকে বের হতে হয়। সে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলো এবং খুবই এক ঘেঁয়েমিপূর্ণ মারামারি-হাতাহাতির একটা সিনেমা দেখতে দেখতে তার আসনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। সিনেমার কি আর বিষয় ছিলো না? সব সময় কেন একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি হয় – স্বামীর সাথে তার প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী ও অসুস্থ বাচ্চা, স্বামীর সাথে স্ত্রী, প্রেমিকা ও অসুস্থ বাচ্চা? পৃথিবীতে তো কাহিনী তৈরির আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে।

খাবার ঘরের আলোচনা দীর্ঘ হলো না; ধ্যানের পর সব সদস্যরা অনেক প্রশান্ত বোধ করছে এবং তারা সবাই তাদের ওয়ার্ডে ফিরে গেলো। মারি গেলো না, সে গেলো বাগানে হাঁটতে। যাওয়ার পথে দেখলো যে তরুণীটি বিছানায় যেতে পারেনি। সে সিজোফ্রেনিক এডোয়ার্ড-এর জন্য পিয়ানো বাজাচ্ছে; এডোয়ার্ড বোধ হয় সব সময় পিয়ানোর পাশেই অপেক্ষায় ছিলো। বাচ্চাদের মতো বিকারগ্রস্তদের তাদের ইচ্ছা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এক চুল নাড়ানো যায় না।

বাইরে বাতাস একেবারে বরফের মতো। মারি ফিরে এসে একটা কোট নিয়ে আবার বাগানে বের হলো। বাইরে এসে সবার নজর থেকে একটু দূরে এসে সে একটা সিগারেট ধরালো। সে ধীরে ধীরে অপরাধবোধহীন ভাবে সিগারেট টানছিলো আর তরুণীটির কথা ভাবছিলো। এখানে দাঁড়িয়ে সে পিয়ানোর সুর শুনতে পাচ্ছিলো। আর ভাবছিলো ভিলেট-এর প্রাচীরের বাইরের জীবন কেমন? এটা প্রত্যেকের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠছে।

মারি’র দৃষ্টিতে এই কঠিন অবস্থাটা এ কারণে নয় যে সবকিছুতে বিশৃঙ্ক্ষলা বা হাঙ্গামা বা নৈরাজ্য; বিশৃঙ্ক্ষলা এ কারণে যে সব কিছুই খুব সাজানো। সমাজের এতো নিয়ম আর এতো আইন যে আইন নিয়মের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আবার নতুন নিয়ম আইনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রত্যেকের জীবন অদৃশ্য নিয়মকানুন দিয়ে যেভাবে নির্দেশিত তার একচুল বাইরে যেতে মানুষ ভয় পায়।

মারি জানে সে কী নিয়ে কথা বলছে; তার অসুস্থতা তাকে ভিলেট-এ নিয়ে না আসা পর্যন্ত সে তার জীবনের চল্লিশ বছর কাটিয়েছে আইনজীবী হিসেবে। ন্যায় বিচারের প্রতি তার নিরপেক্ষ দৃষ্টি সে তার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই হারিয়েছে এবং বুঝেছে যে, আইন কোন সমস্যা সমাধানের জন্য তৈরি হয়নি; বরং অনির্দিষ্টকালের জন্য দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখতে তৈরি হয়েছে।

এটা আফসোসের বিষয় যে আল্লাহ, জেহোভা, ঈশ্বর – যে নামেই ডাকা হোক না কেন – আজ আর পৃথিবীতে বাস করেন না; যদি সত্যিই বাস করতেন তাহলে আমরা এখনো স্বর্গে থাকতাম। সেখানে তিনি যদি আপীল, আবেদন, চাহিদা, ইনজাংক্শন, প্রাথমিক অভিযোগপত্র প্রভৃতির জালে পড়তেন এবং যদি অসংখ্য ট্রাইবুন্যালে যাচাই করে দেখতেন তাহলে হয়তো দেখা যেতো সামান্য যে কারণে আদম ও হাওয়াকে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন তার কোন আইনগত ভিত্তি ছিলো না যেখানে আইন হচ্ছে: ভালো ও মন্দ জ্ঞান বৃক্ষ এর ফল তোমরা খাবে না।

যদি তিনি এটা ঘটুক না-ই চাইবেন তাহলে কেন এটাকে বাগানের মধ্যে রাখলেন এবং কেন এটাকে স্বর্গের বাইরে নিয়ে রাখলেন না? মারিকে যদি ঐ দম্পতিকে রক্ষা করতে ডাকা হতো, তাহলে মারি নিঃসন্দেহে ঈশ্বরকে প্রশাসনিক গাফিলতির জন্য অভিযুক্ত করতো। কারণ ভুল স্থানে এ গাছ লাগানো ছাড়াও তিনি এ জায়গার চারপাশে সতর্কতা ও প্রতিরোধকের কোন ব্যবস্থা রাখেননি; এমন কি তিনি ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন, এবং এ কারণেই প্রত্যেকের জন্য এটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

মারি ঈশ্বরকে অপরাধ কর্মকাণ্ড করতে প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগেও অভিযুক্ত করতে পারতো। কারণ তিনি আদম ও হাওয়াকে ঐ বৃক্ষের সঠিক অবস্থান চিনিয়ে দিয়েছেন। তিনি যদি কিছুই না বলতেন তাহলে ঐ নিষিদ্ধ ফলের প্রতি সামান্যতম কৌতুহল না দেখিয়েই বংশ পরম্পরা কেটে যেতো। যেহেতু ঐ বৃক্ষ বনের অন্যান্য বৃক্ষের মতো বলে অনুমান করা যায় কাজেই কেউ এর বিশেষ কোন মূল্য দিতো না।

কিন্তু ঈশ্বর সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবে এগিয়েছেন। তিনি একটা নিয়ম বানিয়েছেন এবং কাউকে প্ররোচিত করে এটা ভাঙ্গার একটা উপায় বের করেছেন কেবলমাত্র শাস্তির বিষয়টি নিয়ে আসার জন্য। তিনি জানতেন আদম আর হাওয়া পূর্ণ শুদ্ধতার একঘেয়েমিতে ভুগবে এবং আগে বা পরে তাঁর ধৈর্য পরীক্ষায় নামবে। এ কারণে তিনি একটা ফাঁদ পাতলেন, সম্ভবতঃ সর্বশক্তিমান ঈশ্বরও সবকিছু এতো স্বাভাবিক চলছে দেখে একঘেয়েমিতে ভুগছিলেন। যদি হাওয়া ফলটি না খেতেন তবে গত কয়েক কোটি বছরে কিছুই ঘটতো না।

যখন আইন ভাঙা হলো, তখন ঈশ্বর – সর্বোচ্চ বিচারক – তাদের প্ররোচিত করতে এমন ভান করলেন যেন তিনি প্রতিটি সম্ভাব্য গোপন স্থানের বিষয়ে জানেন না। খেলায় আমোদিত হয়ে দেবদূতদের (তাদের জন্য জীবন নিশ্চয় সেখানে বিস্বাদ, নইলে শয়তান স্বর্গ থেকে বেড়িয়ে আসতো না) সাথে নিয়ে তিনি স্বর্গের বাগানে ভ্রমণ করতে লাগলেন। মারি ভাবছিলো, বাইবেলে কী চমৎকারভাবে অনিশ্চিয়তার দৃশ্যটা সাজানো হয়েছে: ঈশ্বরের পদাঙ্ক, দম্পতির ভীত দৃষ্টি বিনিময়, তাদের লুকানোর স্থানে ঈশ্বরের থেমে যাওয়া।

“তোমরা কোথায়?” ঈশ্বর জানতে চাইলেন।

“আমি আপনার কণ্ঠস্বর বাগানে শুনলাম এবং আমি ভীত ছিলাম, কারণ আমি ছিলাম নগ্ন; এবং আমি নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম,” আদম উত্তর দিলো। আদম জানতো না যে এই বক্তব্যের মাধ্যমে সে নিজ অপরাধে অপরাধী হিসেবে স্বীকার করে নিলো।

তাই, আদম কোথায় রয়েছে অথবা সে কোথা পালিয়ে গেছে তা না জানার ভান করার মতো সাধারণ কৌশল খাটিয়ে ঈশ্বর যা চেয়েছিলেন তা আদায় করলেন। এমন কি দেবদূতদের দর্শকশ্রেণিতে যারা ঐ দৃশ্য অপলক পর্যবেক্ষণ করছিলো তারা যেন কোন সন্দেহ না করে সেজন্য তিনি আরো একটু অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

“কে তোমাদের বলেছে যে তোমরা নগ্ন?” ঈশ্বর জানতে  চাইলেন এবং তিনি জানতেন যে, এ প্রশ্নের একটিই সম্ভাব্য উত্তর: “কারণ আমি ভালো ও মন্দ জ্ঞান বৃক্ষের ফল খেয়েছি।”

এই প্রশ্নের দ্বারা ঈশ্বর দেবদূতদের দেখালেন যে তিনিই ঈশ্বর, এবং দম্পতির উপর তাঁর দণ্ডাজ্ঞা নিখুঁত প্রমাণ সাপেক্ষ। এটা নারীর ত্রুটি কি না অথবা তারা ক্ষমা প্রার্থনা করেছে কি না তা কোন ব্যাপার নয়; আসল কথা হচ্ছে তখন থেকে ঈশ্বরের একটা উদাহরণের প্রয়োজন যেন পার্থিব বা অপার্থিব যে কোন জীবই উনার সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সাহস না করে।    

ঈশ্বর দম্পতিকে বিতাড়িত করলেন, এবং তাদের বংশধরদেরও এর মূল্য দিতে হলো (যেমন এখনো অপরাধীদের সন্তানদের ক্ষেত্রে যেমন ঘটে) এবং এভাবেই বিচার ব্যবস্থা আবিষ্কার হয়েছে: আইন ও আইন লঙ্ঘন (এটা ব্যাপার না আইনটা কতটা অযৌক্তিক বা ফালতু), বিচার (যেখানে অধিকতর অভিজ্ঞরাই সরলদের উপর জয়ী হয়), এবং শাস্তি।

যেহেতু সকল মানবতা কোন ধরনের আপীলের অধিকার রাখে না, তাই মানবসমাজ ঈশ্বরের চূড়ান্ত অবস্থানের বিরুদ্ধে একটা প্রতিরক্ষা কৌশল তৈরি করেছে নিজেদের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা ব্যবহার করে একই পথে চলার সিদ্ধান্ত নিয়ে। যাই হোক, হাজার হাজার গবেষণা এতো বেশি আইনগত ব্যবস্থা বের করে দিয়েছে যে, চূড়ান্তভাবে আমরা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছি। বিচার ব্যবস্থা ধারা, আইনশাস্ত্র, এবং পরষ্পরবিরোধী বক্তব্যের এমন একটা জট পাকিয়েছে যেটা কারো পক্ষে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব না।

এতো বেশি জট পাকিয়েছে যে যখন ঈশ্বর মন পরিবর্তন করলেন এবং তার পুত্রকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পাঠালেন, তখন কী ঘটলো? তিনি প্রবল বিচার ব্যবস্থার আওতায় পড়লেন যেটা ঈশ্বর তৈরি করেছেন।

আইনের পাকানো জট এমন বিভ্রান্তি তৈরি করলো যে ঈশ্বর পুত্রকে ক্রুশবিদ্ধ হতে হলো। এটা কোন সহজ বিচার ছিলো না; তাকে অ্যানানিয়াস থেকে কাইফাসে স্থানান্তর করা হলো, ধর্মযাজক থেকে পিলোত (গভর্নর)-এর কাছে যিনি অভিযোগ তুললেন যে রোমন বিচার ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত আইন নেই। পিলোত থেকে গেলো হেরাদ-এর কাছে যিনি পাল্টা অভিযোগ তুললেন যে ইহুদি আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। হেরাদ থেকে আবার পিলোত-এর কাছে ফেরত আসলো, যিনি এর একটা সমাধান খুঁজে বের করতে লোকজনকে একটা বিচার সংক্রান্ত প্রস্তাব দিলেন: তিনি ঈশ্বর পুত্রকে প্রহার করে জনতার সামনে প্রদর্শন করতে পারেন, কিন্তু এতে কাজ হলো না।

বর্তমানকালের একজন উকিলের মতো পিলোত নিজেকে বাঁচাতে একজন শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীকে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি যিশুর পরিবর্তে বুরাহবুসকে ব্যবহারের প্রস্তাব দিলেন। তিনি জানতেন যে সে সময় নাগাদ বিচার একটা প্রধান প্রদর্শনী হয়ে উঠবে যার একটাই দাবি: বন্দীর মৃত্যু।

শেষ পর্যন্ত পিলোত আইনের সেই ধারা ব্যবহার করলেন যেটা যার বিচার হচ্ছে তাকে নয় বরং বিচারককে বেনেফিট অব ডাউট এর সুযোগ দিয়েছে। তিনি ব্যাপার মিটিয়ে হাত ধুঁয়ে ফেললেন যার অর্থ: “আমি কোন ভাবে পুরোপুরি নিশ্চিত নই।” রোমান বিচার ব্যবস্থার আর একটি বিকল্প কৌশল ছিলো কোথাও শাস্তি কোন ঝামেলার কারণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সেখানে স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট-এর সাথে সম্পর্কের কোন ক্ষতি না করে সিদ্ধান্তের ভার জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া যেতো। আর রাজধানী থেকে একজন পরিদর্শক নিজে এসে যাচাই করতেন কী ঘটছে।

বিচার ও আইন – নিরপরাধীকে রক্ষা করতে উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এটা কারো পছন্দ মত কাজ করে না। এ সকল বিভ্রান্তি থেকে দূরে থাকতে পেরে মারি খুশি। যদিও আজ রাতে পিয়ানো শুনতে শুনতে সে ঠিক নিশ্চিত ছিলো না ভিলেট তার জন্য সঠিক স্থান কি না।

“আমি যদি একবার সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম এবং এখানকার সব কিছু ছেড়ে যেতে পারতাম, তাহলে আমি আর আইন পেশায় ফিরে যেতাম না। আমি আর ঐ সব বিকারগ্রস্ত লোকের সাথে আমার সময় কাটাতে চাই না যারা নিজেদেরকে স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, কিন্তু যাদের জীবনে আসল কাজ হচ্ছে অন্যদের কাছে সব কিছু আরো কঠিন করে তোলা। প্রয়োজনে আমি দরজির কাজ করবো, সেলাই এর কাজ করবো, মিউনিসিপ্যাল থিয়েটারের সামনে ফল বিক্রি করবো। আমি এই নিরর্থক বিকারগ্রস্ত আইন পেশায় ইতিমধ্যে যথেষ্ট সময় নষ্ট করেছি।”

ভিলেট-এ সিগারেট খাওয়ার অনুমতি রয়েছে কিন্তু সিগারেটের অবশিষ্টাংশ লনে ফেলা যায় না। মারি পরম আনন্দের সাথে সে কাজটিই করলো যেটা নিষেধ, কারণ এখানের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে নিয়মের প্রতি কোন শ্রদ্ধা না থাকলেও চলে এবং নিয়ম ভাঙলেও কোন বড় শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় না।

সে মূল ফটকের দিকে গেলো। নিয়ম মতো সেখানে সব সময় একজন প্রহরী থাকে, প্রহরী তাকে দেখে মাথা ঝাঁকালো ও ফটক খুলে দিলো।

“আমি বাইরে যাবো না,” সে বললো।

“কি চমৎকার পিয়ানো বাজছে,” প্রহরী বললো। “আমি প্রায় রাতেই শুনি।”

“আমি আর বেশি দিন থাকবো না,” এ কথা বলে সে দ্রুত হেঁটে চলে গেলো যেন যে কথা বললো তা আর বুঝিয়ে বলতে না হয়।

মারি’র হঠাৎ মনে পড়লো সে খাবার ঘরটায় তরুণীটির চোখে কী দেখতে পেয়েছিলো: আতঙ্ক।

আতঙ্ক। ভেরোনিকা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করতে পারে, দ্বিধা বোধ করতে পারে, লজ্জা বা কুণ্ঠা বোধ করতে পারে, কিন্তু আতঙ্ক কেন? এটা তখনই হতে পারে যদি সে কোন প্রকৃত হুমকির মুখোমুখি হয়: কোন হিং¯্র পশু, অস্ত্রধারী হামলাকারী, ভূমিকম্প এগুলো হতে পারে, কিন্তু খাবার ঘরে ভীড় করা এক দল লোক হতে পারে না।

কিন্তু মানুষই এমন, তার কাছে মনে হলো। আমরা আমাদের সব আবেগকে আতঙ্কে পরিণত করি।

মারি জানে সে কী নিয়ে ভাবছে, এটাই তাকে ভিলেট-এ নিয়ে এসেছে: আতঙ্কগ্রস্ততা।

এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ নিয়ে মারি’র রুমে যথার্থই একটি লাইব্রেরি আছে। আজকাল মানুষ এটা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করে। সেদিন সে একটা জার্মান টেলিভিশনে একটা অনুষ্ঠান দেখলো যেখানে কয়েকজন তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করছে। একই অনুষ্ঠানে একটা জরিপের ফল থেকে বলা হলো যে মোট জনসংখ্যার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আতঙ্কগ্রস্ততায় ভুগে থাকে। লক্ষণ প্রকাশ পেলে তাদেরকে মানুষজন মানসিক রোগী মনে করতে পারে এ ভয়ে অসুস্থ ব্যক্তিরা সচরাচর তাদের লক্ষণগুলো লুকাতে চেষ্টা করে।

কিন্তু মারি যখন প্রথম এ সমস্যায় পড়ে তখন এতো কিছু জানা ছিলো না। এটা একেবারে নরক, একটা সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে সে ভাবছিলো।

এখনো পিয়ানো বাজছে; মেয়েটার মনে হয় সারা রাত বাজানোর মতো যথেষ্ট বল রয়েছে।

তরুণীটির হাসপাতালে আসাটা এখানকার অনেক নিবাসীকেই প্রভাবিত করেছে, মারি তাদের একজন। প্রথমে মারি তাকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলো এই ভয়ে যে, সে হয়তো তরুণীটির বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তুলবে। যেহেতু পালানোর কোন পথ নেই, তাই তাকে মরে যেতে দেয়াই ভালো। ডা. ইগোর-এর এটা জানা দরকার ছিলো, যদিও তাকে প্রতিদিনই ইনজেকশন দেয়া হচ্ছে কিন্তু তার শারীরিক অবস্থা দৃশ্যমান ভাবেই খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং তাকে বাঁচানোর কোন উপায়ও নেই।

নিবাসীরা এ বিষয়টা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে এবং নিজেদেরকে ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাওয়া মেয়েটি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। তবে কেউই জানে না কেন যেন ভেরোনিকা তার জীবনের লড়াই শুরু করেছে এবং মাত্র দু’জন ব্যক্তি তার কাছাকাছি ঘেষছে; জেডকা, যে আগামীকাল চলে যাচ্ছে ও খুব একটা কথাও বলে না এবং এডোয়ার্ড।

মারি’র এডোয়ার্ড-এর সাথে কথা বলা দরকার; সে মারি’র মতামতকে সব সময় গুরুত্ব দেয়। এডোয়ার্ড কি বুঝতে পারছে না সে ভেরোনিকাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসছে এবং সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে সে এটা এমন একজনের সাথে করছে যার পরিত্রাণের কোন আশা নেই?

মারি এডোয়ার্ড-এর কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার অনেকগুলো উপায় নিয়ে ভাবলো, কিন্তু সবগুলোই তাকে অপরাধ বোধে ভোগাবে যেটা সে করতে পারবে না। মারি সামান্য ভাবলো এবং ঠিক করলো বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবেই চলতে দিবে। সে তো আর আইনজীবী না এখন এবং সে এ রকম একটা স্থানে আচরণের নতুন নিয়ম তৈরি করে একটা বাজে উদাহরণ সৃষ্টি করতে চায় না যেখানে অরাজকতারই রাজত্ব করা মানায়।

তবে তরুণীটির উপস্থিতি অনেককেই স্পর্শ করেছে এবং অনেকে তাদের জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবছে। ভাতৃসংঘের একটা সভায় সেদিন একজন ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলো আসলে কী ঘটছে। ভিলেট-এ মৃত্যু হঠাৎ-ই ঘটে কাউকে কিছু ভাবার সুযোগ না দিয়েই, অথবা দীর্ঘ রোগ ভোগের পর আশীর্বাদের মতো মৃত্যু আসে।

এক্ষেত্রে তরুণীটির বিষয়টিতে নাটকীয়তা রয়েছে কারণ সে বয়সে তরুণ এবং এখন সে আবার বেঁচে থাকতে চায় – এটা এমন চাওয়া যে সবাই জানে তা ঘটা সম্ভব না। কেউ কেউ নিজেকে প্রশ্ন করেছে যদি আমার ক্ষেত্রে এমন হতো? আমার যদি বেঁচে যাওয়া সুযোগ থাকতো আমি কি এর সঠিক ব্যবহার করতে পারতাম?

কেউ কেউ এর উত্তর খুঁজতে যায়নি; তারা এ চিন্তা অনেক আগেই বাদ দিয়েছে এবং এমন এক জগত তৈরি করে নিয়েছে যেখানে জীবন বা মৃত্যু, স্থান বা কাল কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। আবার কেউ কেউ এটা নিয়ে গভীর ভাবে ভাবতে বসেছে, মারি তাদের একজন।

আঠারো

ভেরোনিকা কিছুক্ষণের জন্য পিয়ানো বাজানো থামালো এবং বাগানে তাকিয়ে মারিকে দেখতে পেলো। সে রাতের ঠান্ডা বাতাসে একটা মাত্র পাতলা জ্যাকেট পরে রয়েছে। সে কি মরতে চায়?

না, আমি না সেই ব্যক্তি যে মরতে চাচ্ছে।

সে আবার পিয়ানো বাজাতে লাগলো। জীবনের শেষ দিনগুলোতে এসে সে চূড়ান্তভাবে বুঝতে পেরেছে তার আসল স্বপ্ন কী: তার স্বপ্ন হচ্ছে মন প্রাণ দিয়ে পিয়ানো বাজানো, যতক্ষণ তার মন চায় এবং যখনই তার মন চায় তখন। এটা কোন ব্যাপার না যে তার একমাত্র শ্রোতা এক তরুণ সিজোফ্রেনিক রোগী; তাকে দেখে মনে হয় সে মিউজিক বুঝতে পারছে আর সেটাই ব্যাপার।

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০