fbpx

ভেরোনিকা ডিসাইড্‌স্‌‌ টু ডাই

এগারো

খোলা জানালার বাইরে আকাশ জুড়ে তারা; পাহাড়ের পেছন থেকে নতুন চাঁদ উঠেছে। কবিরা পূর্ণিমা ভালোবাসে, তারা পূর্ণিমা নিয়ে হাজারো কবিতা লিখে। কিন্তু ভেরোনিকার পছন্দ মুচকি হাসি দেয়া চাঁদ। কারণ তখনও চাঁদের বেড়ে উঠার সময়, ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ তলকে আলোকিত করার সময়।

এরকম একটা রাতে লিভিং রুমের পিয়ানোতে ভেরোনিকার স্কুলে শেখা একটা মনোরম সোনাটা বাজাতে মন চাচ্ছিলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে তার অসম্ভব ভালো লাগতে লাগলো যেন মহাবিশ্বের সীমাহীন প্রকৃতি তার চিরস্থায়ীত্বকে মেলে ধরেছে। কিন্তু ভেরোনিকার এই অভিলাষের মধ্যে বাঁধা হয়ে আছে একটা ইস্পাতের দরজা ও একজন ভদ্রমহিলা যিনি অনন্তকাল ধরে বই পড়ছেন। তাছাড়া এতো রাতে কেউ পিয়ানো বাজালে তার আশেপাশের সবাই তো জেগে উঠবে।  

ভেরোনিকার হাসি পেলো। ‘আশেপাশের সবাই’ মানে তো ওয়ার্ড জুড়ে বিকারগ্রস্ত লোকজন, আর এ সব বিকারগ্রস্ত লোকজন সবাইকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।

ভেরোনিকার ভালো লাগা অনুভূতিটা বাড়তে লাগলো। সে বিছানা থেকে উঠলো এবং জেডকার বিছানার কাছে গেলো। কিন্তু সে-ও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন; খুব সম্ভবত আজকের ভয়ঙ্কর চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যাবার কারণে ক্লান্তিতে ঘুমাচ্ছে।

“বিছানায় যাও,” নার্সটি ভেরোনিকাকে দেখে বলে উঠলো। “ভালো মেয়ের মতো ঘুমালে দেবদূত নয় তো প্রেমিককে স্বপ্ন দেখবে।”

“আমাকে বাচ্চা মনে করবেন না। আমি ওসব পাগলীদের মতো খেলো না যে, যা বলবেন তাতেই ভয় পাবো। আমি হয়তো হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো প্রলাপ বকছি, কিন্তু আমি আমার নিজের জীবনকেই তোয়াক্কা করি না। যাই হোক, আজকে আমি আরো সতর্ক। আজকের চাঁদ দেখে আমার কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে।”

নার্সটি তার প্রতিক্রিয়ায় বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো।

“আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?” ভেরোনিকা জানতে চাইলো। “আর দুই দিনের মধ্যে আমি মারা যাচ্ছি; আমার চাওয়া পাওয়ার আর কী আছে?”

“তাহলে আমি আমার বইটা শেষ করতে করতে তুমি একটু ঘুরে ফিরে আসছো না কেন?”

“যাচ্ছি না কারণ এটা একটা কয়েদ খানা। আর এখানে একজন পাহারাদার রয়েছেন যিনি বই পড়ার এমন ভান করছেন যেন অন্যরা মনে করে সে একজন বুদ্ধিমান মহিলা। সত্যি কথা হচ্ছে, সে প্রত্যেকের প্রতিটা নড়াচড়া লক্ষ্য করছেন এবং বসে বসে দরজার চাবি পাহারা দিচ্ছেন যেন এ ঘরে গুপ্তধন রয়েছে। মনে হচ্ছে এটাই নিয়ম এবং তাকে সেটা অবশ্যই মানতে হবে। আর তাই সে এখানে কর্তাব্যক্তির আসন নিয়ে বসেছেন যেটা তার প্রতিদিনের জীবনে স্বামী-সন্তানদের সাথে সে কখনোই পান না।”

ভেরোনিকা কথাগুলো বলে কাঁপছিলো, কিন্তু কেন তা সে নিজেই জানে না।

“চাবি?” নার্সটি প্রশ্ন করলো। “দরজা সব সময়ই খোলা। তুমি নিশ্চয়ই ভাবছো আমি এখানে এক গাদা মানসিক রোগীকে দরজা বন্ধ করে বসে আছি, তাই না?”

দরজা খোলা মানে? সে কী বলতে চাচ্ছে? কিছু দিন আগেই আমি বাইরে যেতে চাইলাম আর এ মহিলা আমার সাথে টয়লেটে পর্যন্ত গেলো। এখন সে কী বলছে এসব? ভেরোনিকা ভাবছে।

“আমার কথা এতো সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই,” নার্স বললো। “আসল কথা হচ্ছে আমাদের এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এতো কড়াকড়ি নেই, কারণ সবাইকে চেতনানাশক দেয়া আছে। তুমি তো দেখি কাঁপছো, তোমার কি ঠান্ডা লাগছে?”

“আমি জানি না। এটা বোধ হয় আমার হার্টের কারণে।”

“তুমি চাইলে বাইরে হেঁটে আসতে পারো।”

“আসলে আমার পিয়ানো বাজাতে খুব ইচ্ছা করছে।”

“লিভিং রুম তো একেবারে আলাদা, কাজেই তুমি পিয়ানো বাজালে কারো কোন সমস্যা হবে না। তোমার যেটা ভালো লাগে করো।”

ভেরোনিকার কাঁপুনিটা হঠাৎ-ই ধীর, ভীরু ও চাপা একটা ফোপানিতে রূপ নিলো। সে হাঁটু গেড়ে বসে নার্সের কোলে মাথা রেখে বসলো আর কাঁদতে লাগলো।

নার্স বইটা সরিয়ে রাখলো; কষ্ট আর কান্নাটা স্বাভাবিক ভাবে উবে যেতে ভেরোনিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। তারা প্রায় আধ ঘন্টা এভাবে বসে কাটালো, একজন কেঁদে আর একজন সান্ত্বনা দিয়ে যদিও কেউ বুঝতে পারছিলো না কেন বা কী কারণে তারা এমন করছে।

ফোপানিটা শেষ পর্যন্ত থামলো। নার্স তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো এবং তার হাত ধরে দরজার দিকে নিয়ে গেলো।

“তোমার বয়সী আমারও একটা মেয়ে আছে। তুমি যখন প্রথম ভর্তি হয়ে আসলে তখন এক গাদা সুঁই আর নল তোমার সারা শরীর জুড়ে। সে সময় ভেবে খুব অবাক হলাম এমন একটা চমৎকার মেয়ে যার সারা জীবন সামনে পড়ে আছে সে কেন নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলো। তখন নানা ধরনের গুজব চারদিকে ছড়ানো: তোমার লিখে যাওয়া চিঠিটা নিয়ে কথা হচ্ছিলো যেটা আমার কাছে আসল কারণ বলে মোটেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না; কী কারণে তুমি বেশিক্ষণ বাঁচবে না সেটা নিয়ে কথা হচ্ছিলো, কারণ তুমি তোমার হার্টের নিরাময় অযোগ্য সমস্যা করে ফেলেছো। তখন আমি আমার মেয়ের চেহারাটা মাথা থেকে সরাতে পারছিলাম না: সে যদি এমন কিছু করার কথা ভাবে? কেন কিছু লোক প্রকৃতির যে টিকে থাকার নিয়ম তার বাইরে যেতে চেষ্টা করে?”

“এ জন্যই আমি কাঁদছিলাম,” ভেরোনিকা বললো। “যখন আমি ঘুমের ওষুধগুলো খেয়েছিলাম তখন আমি এমন একজনকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম যাকে আমি ঘৃণা করি। কিন্তু তখনও আমি জানতাম না যে, আমার মধ্যে আরো একজন ভেরেনিকা আছে যে ভেরোনিকাকে আমি ভালোবাসতে পারি।”

“কী কারণে মানুষ নিজেদেরকে ঘৃণা করে?”

“খুব সম্ভবতঃ ভীরুতা। অথবা ভ্রান্ত হওয়ার চিরস্থায়ী ভীতি, কিংবা অন্যের আশা পূরণে অক্ষমতা। কিছুক্ষণ আগে আমি সুখী ছিলাম, আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে আমি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে আছি। কিন্তু যখনই আমার মনে পড়লো আমি কোন পরিস্থিতিতে আছি সাথে সাথে আমার ভয় করতে লাগলো।”

নার্স দরজাটি খুলে দিলো, আর ভেরোনিকা বের হয়ে গেলো।

রোকনুজ্জামান

সদস‍্য, সম্পাদনা পর্ষদ, প‍্যাপাইরাস প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশন:১৯৯৯-২০০০